বেশ কদিন
আগের কথা, ভরদুপুরে ঘেমে নেয়ে বাসে করে অফিস যাচ্ছি। আর কলকাতার বাস নিয়ে, মূলত অফিসের
সময়ের বাস নিয়ে যত কম বলা হয় ঠিক ততটাই ভালো। উপায় যখন নেই তখন আর কি বা করা যাবে,
অভিযোগের কোন মানেও হয় না, এভাবেই আমরা অভ্যস্ত। বাসটা পার্কসার্কাস থেকে ঘুরে চার
নম্বর ব্রীজের নীচে যেই না গোঁত খেলো, অমনি পিল পিল করে কোথা থেকে যে এতো লোক এলো সেটা
বুঝতে বুঝতেই আমি অলরেডি দুটো কনুইয়ের মাঝে প্যানকেক। স্যান্ডুইচ হয়তো আশা করেছিলেন
কিন্তু আসলে বলি স্যান্ডুইচে মালপত্র ভরে সেটাকে গ্রীল করা হয়, এখানে দুই কনুইয়ের মাঝে
মালপত্র পড়ে গরমে গ্রীল হচ্ছে বটে কিন্তু সাথে অকুল ধারায় ঘাম মিশে ব্যাপারটা একদম
ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে, তাই প্যানকেক বললে আসল ব্যাপারটা অনুধাবন করা যাবে। সে যাই হোক,
আমি তখন বর্ডারের সানি দেওলের মতো একটা খন্ডযুদ্ধ জিতে একটু মুখ বাড়িয়ে উঁকি ঝুকি মারতে
গিয়ে দেখলাম চোখে চশমা এঁটে, সাদা একটা টি শার্ট পরে এক ছোকরা বাসে উঠেছে। প্রবল ভিড়ের
চাপে গেটের থেকে ভেতরে আসতে না পেরে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে এদিক ওদিক। বাস ছুটছে বাইপাস
দিয়ে।
ইতিমধ্যে
বেশ কটা বাসের স্টপেজ গেছে, কেউ তো নামলই না, বরং উঠলো। সেই সাদা জামা পাকে চক্রে এসে
দাঁড়িয়েছে আমার পাশেই। কোনভাবে কোন অন্য উদ্দেশ্য আমার নেই, আর সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ
একদমই নেই। বার বার দেখার কারন হল ভদ্রলোকের মাথার ওপর দিয়ে একটা পেল্লাই হেডফোন লাগানো,
তার গায়ে লেখা “বোস”। যারা আদতে এই ব্যাপারটা নিয়ে জানেন না, তাদের বলে দি, নামে বাঙালি
হলেও স্বভাবে সুভাষ বোসের আসে পাশে ছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু এই বোস পশ্চিমের দেশের
সাড়া জাগানো এক সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আর তারই ফল হল এই হেডফোন। যাকে পাশ্চাত্যেই মাথায়
তুলে রাখা হয়, প্রাচ্যে যে কি হবে সেটা বুঝতে পারছেন তো?তাই আমার যে দোষ নেই সেটাও
বুঝতে পারছেন। বাইরে থেকে কিছু জিনিস দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটা আমাদের মজ্জাগত।
আগে পার্কস্ট্রীট চত্ত্বরে বিদেশী দেখলেই সেলফি তোলার যা ধুম লাগতো সেটা এখন কমে গেলেও
একবারে নির্মূল হয়নি, চারিয়ে গেছে অন্যদিকে।
এসব জিনিসে
ইন্টারেস্ট থাকার জন্যে এক দুবার ভালো করে দেখেই বুঝতে পারলাম এটা সাউন্ডলিঙ্ক মডেল,
দাম কম করে ২৩০ ডলার, আমাদের টাকার হিসাবটা না হয় নাই দিলাম। তো বুঝতেই পারছেন একটা
বড়লোকি ব্যাপার। তো পাশের লোকের ধাক্কাধাক্কিতে একবার কান থেকে হেডফোনটা নামিয়ে ভদ্রলোক
পাশের লোককে নোংরা ভাবে ঠেললেন। সেই ফাঁকে হেডফোনের থেকে যেটুকু আওয়াজ ভেসে আসে তাতে
বুঝলাম একটা দুমদাম বিট পড়া ইংলিশ গান চলছে। সে চলছে চলুক, তাতে আপত্তি নেই, গান নিজস্ব
একটা জায়গা; কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র শোনা মানুষদেরকে নীচু চোখে দেখাটায়
আপত্তি আছে। তুমি ব্ল্যাক সাবাথ, মেটালিকা, পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনলে হনু আর আমি জয়তি চক্রবর্তী
শুনলে খেলো, এই ভাবধারাতে আমার আপত্তি আছে; হয়তো সবার থাকা উচিত। আর এই ভাবটাই সমাজের
মধ্যে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গেছে। ইংরিজি জানা অবশ্যই ভালো, চর্চা থাকা আরো ভালো;
কিন্তু সেটা কখনোই মাতৃভাষাকে নীচু করে না। সোশ্যাল মিডিয়ার দেখনদারির যুগে ভুলভাল
ইংরাজিতে দু কলি লেখার থেকে এক কলি ঠিক বাংলায় লেখাটা অনেক বেশি সম্মানের, অন্তত সেরমটা
ভাবাটাই উচিত। সেখানে ভুল লিখলে যতটা হাসি ঠাট্টা হবে, নিজের ভাষায় লিখলে অন্তত কিছুটা
হলেও কম হবে; হয়তো লাইক কম পড়বে, কম কমেন্ট পড়বে, কিন্তু সম্মানটাতো বাঁচবে।
এর কারন
যদি খুঁজতে যাই তাহলে হয়তো অনেক কিছু উঠে আসবে। বিদেশি জিনিসের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষন,
তাদের মতো হতে চাওয়া বা সেরম হবার স্বপ্ন দেখা। আবার এটাও বলা যায় ইংরাজি দুনিয়াব্যাপি
একটা সার্বিক মাধ্যম হয়ে ওঠার জন্যে তার আরো কাছাকাছি যেতে চাওয়া। দুনিয়ার সব ভালো
কাজ ইংরাজিতে হয় এই ভুল ধারণা থাকার জন্যেও হয়তো কিছুটা হয়েছে। আর সর্বোপরি দেখনদারি
ব্যাপার। সেদিন একটা গানের স্কুলে গেছি, দেখি একটা বাচ্চার মা তার টিচারকে হেসে হেসে
বলছেন, “ওকে, একটু এই গানটা ইংরাজি ‘ফন্টে’ লিখে দেবেন তাহলে গাইতে পারবে আরকি। আসলে
ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তো, তাই বাংলাটা ঠিক পড়তে পারেনা।” পরে জানতে পারলাম বাচ্চাটির
নাম সুমন দে, একটা গড়পড়তা বাঙালি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে; যাদের খাবার টেবিলে
হয়তো ডাল ভাতই থাকে, রিসোতোর নামও হয়তো কেউ শোনেনি; কিন্তু আলুভাতেকে ম্যাসড পটাটো
বলে ডাকতে পছন্দ করে। ব্যক্তিগতভাবে এটা মনে করি একজন বাঙালির ছেলে হয়ে যদি বাংলা না
পড়তে বা বলতে পারে তাহলে সেটায় লজ্জিত বোধ করা উচিত, গর্ব না।
আজ
২১শে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ হয়তো সবাই অনেক কিছু লিখবে, আর
তারাও লিখবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বাংলা হরফেই লিখবে যে তারা কতোটা ভালোবাসে মাতৃভাষাকে।
কাল থেকে যে কে সেই, অনেকে হয়তো এটাও জানে না ২১ শে ফেব্রুয়ারী আসলে বিখ্যাত কেন। আমি
নিজে বাঙালি বলে বাংলায় লিখলাম, কোন জার্মান হয়তো জার্মান ভাষায় লিখবে, ফরাসি কেউ
ফ্রেঞ্চে। খুব খারাপ লাগে এটা ভেবেই যেই নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে নাকি দেশ ছাড়তে
হয়, তবে নাকি তার মর্ম বোঝা যায়। দিনের শেষে বিদেশি ভাষার তলায় চাপা পড়া একটা মানুষ
যখন নিজের মন থেকে ক্ষোভটা বের করে তখন মুখ দিয়ে “ধুর শালা!!!”(একজন বাঙালি হিসাব
করে লিখলাম)-টা বেরিয়ে আসে, অন্য কিছু না। যে ভাষার সাথে ‘মা’ জড়িয়ে আছে সেই ভাষা থেকে
মানুষ কিভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়? আজ আমি বলছি, সাথে আরো অনেকে বলছেন; আগেও বলেছেন
পরেও বলবেন। আশা করবো এভাবেই একটা নতুন ভোর আসবে। সেটার আগে অন্তত সকল ভারতবাসীর
একটা কথা জানা দরকার, ভারতবর্ষের কোন জাতিয় ভাষা নেই। নিজের ভাষাকে ভালোবাসুন,
সমাদর করুন, আরো অন্য ভাষাও শিখুন; প্রগতি কখনো ভাষাকে আঁকড়ে এগোয় না।
ভাষা আন্দোলন করে বাঁচে না, ভাষা বাঁচে চর্চায়।
No comments:
Post a Comment