-
মানিক কাকু ছেলেটাকে ফুটবলে ভর্তি করে দিতে পারে তো, কি
দারুন খেলার সেন্স।
-
হ্যাঁ সে তো পারেই, কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? ওই তো ছোট একটা
মুদিখানার দোকান। কত টাকাই বা আসে ওখান থেকে।
-
হ্যাঁ মানলাম, কিন্তু তা বলে এভাবে... কতো টাকাই বা লাগবে
আর।
-
আরে জুতো জামা না হয় এককালীন কিনে নিল, কিন্তু তারপরেও তো
আরো অনেক খরচা থেকেই যায়। ভালো খাওয়া দাওয়া,এটা সেটা,কিছু না কিছু আছেই।
-
তা বলে এভাবে একটা ভালো ছেলে...
-
দেখ এখন কাছে পিঠে পরীক্ষা নেই তাই এসব ভাবার সময় পাচ্ছিস।
এর পর পরীক্ষা এসে গেলে আবার খেলা বন্ধ, যে কে সেই। কি হবে এতো কিছু ভেবে?
-
না ঠিক সেটা না, বাট কিছুই কি করা যায় না?
-
আচ্ছা কি করতে চাস বল?
-
না মানে, কিছু... আই মিন কিছুই...
-
সে না হয় পরে দেখা যাবে। এখন বাড়ি যাই বুঝলি, সন্ধ্যে হয়ে
গেছে অনেকক্ষন।
-
আচ্ছা ঠিক আছে, কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। বলটায় একটু হাওয়া দিয়ে
নিস তো, কমে গেছে মনে হচ্ছে, পায়ে লাগছিল বেশ।
-
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি হাওয়া দিয়ে আনবো কাল। চল, বাই।
-
বাই...
সন্ধ্যের আবছায়া আলোর মধ্যে নিমেষে হারিয়ে গেল সানি। কাল আবার খেলার সময় দেখা
হবে। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে দেবুও আস্তে আস্তে হাঁটা লাগালো বাড়ির পথে।
মানিক পাড়ার মোড়েই একটা মুদির দোকান চালায়। আগে যদিও কিছু
বিক্রিবাটা হতো এখন সেসব আরো কমে গেছে। সেই বাড়ির ছেলে বুবাই,
মাথায় খালি ফুটবল আর ফুটবল। পাশের পাড়ার একটা ছোট আধা সরকারী স্কুলে পড়ে। পড়াশোনা
চাড়া বাকি সময়ে খালি ফুটবল আর ফুটবল। খালি পায়ে শীর্ণ শরীরে চষে ফেলে ক্লাবের মাঠটা।
বয়সে অনেক ছোট, সবে ক্লাস সেভেন হবে হবে কিন্তু কি অনায়াসে কাটিয়ে নিতে পারে দু
তিনটে প্লেয়ারকে। বাড়িতে টিভি নেই, তাই খেল লা সেভাবে দেখতে পারে না, ওই ক্লাবে
বসেই যেটুকু দেখা। কিন্তু ক্লাবে মদ গাঁজার আড্ডা যে হারে বেড়েছে তার জন্যেই ওর মা
আর খেলা দেখতে পাঠায় না ক্লাবে, পাছে ছেলে গোল্লায় যায়। খেলা দেখা আরই কমে গেছে। যেদিন
জানতে পেরেছে আমি খেলা পাগল সেদিন থেকেই মাঝে মাঝেই আমার বাড়ি আসে। মনে প্রাণে আর্সেনাল
সাপোর্টার হলেও পছন্দের প্লেয়ার মড্রিচ। ওই ছোট ছোট পাস, অল্প জায়গায় ঘুরে একটা বিষাক্ত
পাস বাড়ানো, এসব গুলো কেমন গোগ্রাসে গিলে নেয় আর মাঠে গিয়ে অবিরাম প্র্যাকটিস করতে
থাকে। একবার খেলা দেখতে দেখতে বলেছিলাম,
-
হ্যারে হতভাগা, আমার সাথে বসে খেলা
দেখিস আর আর্সেনালকে সাপোর্ট করিস! তোর লজ্জা করে না? আমার রাইভাল টিমকে সাপোর্ট
করিস।
-
আরে কি করবো, তখন তো বেশি খেলা বুঝতাম
না, ক্লাবে বসে বিভাষদার সাথে আর্সেনালের খেলা দেখতাম। সেই দেখে দেখেই এদের সাপোর্ট
করি। এখন বিশেষ ভালো খেলে না, কিন্তু শুরু থেকে এদের সাপোর্ট করে আসছি তো। কি আর
করা যাবে।
-
এবার থেকে করবি না, বুঝলি?
-
সে কি করে হয় বলো, তুমি পারবে
ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করতে?
-
এই তো না, একটা নাকল বল মেরে দিলি।
এবার কিভাবে আটকাবো...!!!
-
হা হা হা। ওদের ওই বুড়ো কোচটাকে
দারুন লাগত। কতো বাচ্চা ছেলে খেলতো বলত ওর সময়ে। এখন আর সেসব দেখতেই পাই না।
-
তোর ইচ্ছা করে ওদের মতো খেলতে?
-
সে তো করেই।
-
বাবাকে বলে ফুটবল ক্লাবে ভর্তি হোস
না কেন?
-
ধুর কি যে বলো...!!! মা বলেছে খেলে
কিছু হবে না, পড়াশোনা করলে একটা চাকরি বাকরি জোটাতে পারব নাহলে কিছুই করতে পারবো
না। না খেয়ে মরতে হবে। তাই আর সেভাবে খেলা হয় না...
-
পড়াশোনা যে কি হচ্ছে সে তো দেখতেই
পাচ্ছি। সেদিনই দেখলাম ভর দুপুরে তুই আর কটা বাঁদর মিলে মাঠে বল পেটাচ্ছিস।
-
এই কবে? না না, তুমি ভুল বলছ।
-
আবার? এই গেল সপ্তাহেই দেখলাম শনিবার।
বল তুই প্রতিশ্রুতির মাঠে খেলিস নি?
-
ওহ হ্যাঁ, সেদিন তো আমাদের খেলার
সেমিফাইনাল ছিল, তাই। স্কুলে টুর্নামেন্ট চলছে।
-
ওহ আচ্ছা।
সেদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম আমি, বাকি দিনের থেকে একটু আগেই
ফিরে আসছিলাম। তো খেলা হচ্ছে দেখে স্বভাব বশতই দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি বুবাই খেলছে।
একটা ষন্ডামার্কা ছেলেকে বোকা বানিয়ে সুন্দর নাটমেগ করে বলটা যেভাবে নিয়ে বেরোল
সেদিনকেই বুঝেছিলাম এ ছেলে বহুদূর যাবে। ভাবতে ভাবতে সামনে দেখার আগেই দেখি বুবাই আরো
একটাকে কাটিয়ে বল বাড়িয়েছে ডানদিকের প্লেয়ারটাকে। মিনিট তিনেক থেকে বেরিয়ে আসার আগেই
দেখি একটা বিশ পঁচিশ গজের মাপা থ্রু বাড়ালো বুবাই। সব বাধা ফেলে বলটা এগিয়ে যাচ্ছে,
কিন্তু কাজের তাড়ায় আর সেদিন পিছনে ফিরে দেখতে পারিনি। বলটা এগিয়ে যাচ্ছে...
৭ই মার্চ। স্বভাবত অঝোর বৃষ্টি ভেজা প্যারিসের প্রাক দে প্রিনসেস। ইউফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলর খেলা শুরু হবে। ঘরের মাঠে দুরমুশ করে
এমনিতেই ফুটছে পিএসজি। সামনে আবার কঙ্কালসার ম্যান ইউ। টিমটার কিছু নেই বললেই চলে,
প্রথম টিমের দশজন আসল খেলোয়াড নেই, রয়ে গেছে কিছু ঝড়তি পড়তি খেলোয়াড়, সারা বছর বেঞ্চের
পরিচিত মুখ আর সদ্য ডিমফোটা কিছু বাচ্চা(পড়ুন অ্যাকাডেমি প্লেয়ার) যাদের মধ্যে
একজনের আবার সামনেই শুক্রবার স্কুলে পরীক্ষা। যাদের প্রথম টিমকে ঘরের মাঠে দু গোল
করে দিয়ে এসেছে তাদের থার্ড টিমকে কি আর ভয় করবে পিএসজি, তাও আবার নিজেদের ডেরায়। খেলায়
পরিণতি হয়তো কিছুটা জানাই ছিল, তাই আর ডাকিনি বুবাইকে। খেলার ব্যাপারে নিজের দুঃখ কারো কাছে প্রকাশ
পেয়ে গেলেই কেমন একটা আলাদা লজ্জা লাগে, নিজেকে বেয়াব্রু মনে হয়। সেই ভয় থেকেই আমি
ডাকিনি বুবাইকে। আর রাত সাড়ে তিনটে অবধি জেগে কি বা খেলা দেখবে, ওরই পড়াশোনার ক্ষতি।
কিন্তু ভবিতব্য হয়তো অন্য কথা বলছিল। দু গোলের কাঁটা নিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া
একটা টিম যে দু মিনিটেই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গোলকিপারকে এক লহমায় ছিটকে দিয়ে ফাঁকা
গোলে বল ঠেকে দেবে সেটা বোধহয় ঈশ্বরই জানতেন। আবার ঠেলেছে ত ঠেলেছে সে, যাকে কিনা
সারা বছর ধরে সমালোচনায় বেঁধে দিয়েছে সমর্থকরা। একে অঝোরে বৃষ্টি, ক্রমাগতই পিছলে
যাচ্ছে পা, সে অবস্থাতেও ওরম বিপুল ক্ষিপ্রতায় ছুটে ঝটিতে গোলকিপারকে কাটিয়ে, এক
প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে লাগাম ছাড়া বলকে দিশা দেওয়ার মধ্যে থেকে ফুটে উঠলো একটা
নিম্নবিত্ত মানুষের এই সমাজের চাপে বেঁচে থাকার প্রবল প্রচেষ্টা। এইখানে হয়তো অদম্য
ইচ্ছার কাছে গুনমানকেও মাথা নামিয়ে নিতে হয়। ২-০ তে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ গিয়ে দাঁড়ালো
২-১ এ।
[বুফনকে ছিটকে দিয়ে প্রথম গোলের পথে
লুকাকু]
দল জানতো, সিংহ যতই বিপন্ন হোক না কেন, সে আসলে সিংহই।
এক গোল খেয়ে যেতেই যে বানের মতো আক্রমণ ধেয়ে আসবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই
সুযোগেই সিঁধ কেটে একটা গোল করে গেল পিএসজি। খেলার ফল ৩-১। কিন্তু রাখে হরি তো
মারে কে। বৃষ্টির দাপটে জোরালো শট যখন মাটিতে পড়ে স্কিড করে আরো জোরে বুঁফোর কাছে
গেল তখন সেই চিরন্তন নির্ভরতা দেওয়া দস্তানাও কেমন ভেবলে গেল, পারলো না সেই বলকে
নিজের কাছে রাখতে। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো সেই ছিটকে আসা বলকে গোলে পাঠাতে কোন ভুল
করেনি লুকাকু। স্কোর দাঁড়ালো ৩-২। মধ্যান্তরে গেল দু দল ৩-২ অবস্থাতেই, এক দলের চোখে
ঘুরে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার, আর একদলের কাছে পায়ের তলার সরতে থাকা মাটি আঁকড়ে রাখার
তাগিদ। খেলা বদলে গেল মধ্যান্তরের পরেই। একদলের অঙ্গীকারের কাছে মাথা নামাতেই হলো
অন্য দলকে। ম্যান ইউ এর প্রচন্ড আক্রমণের সামনে ক্রমেই পিছু হটতে থাকলো পিএসজি। কিন্তু
খেলা তখন ৩-২ তে আটকে। ম্যাচের শেষের দিকে আর বৃষ্টি মাঠের সাথে না পেরে আস্তে আস্তে
পেশি গুলো যখন গা ছাড়া দিয়ে দিচ্ছিল তখনই বেঞ্চ থেকে উঠে এলো তাহিত চং আর ম্যাসন গ্রীনউড।
বয়স কতই আর হবে, মেরে কেটে আঠারো, আমাদের বুবাইয়ের থেকে বছর খানেকের বড়। কিন্তু আজ
এসে দাঁড়িয়েছে একটা মহাযুদ্ধের সামনে। চোখে ভেসে উঠছে জ্বলে ওঠার অঙ্গীকার, কিছু
করে দেখানোর তাগিদ। নব্বই কোটায় যখন থমকে দাঁড়ালো তখন একবার মনে হল টিভিটা বন্ধ
করে দি, আর দেখে কি হবে। কিন্তু মনটা সায় দিল না। ঠিক তার কিছুক্ষন পরেই ড্যালোটের
শট হাতে লাগতেই মনটা আনন্দে গেয়ে উঠলো পেনাল্টি আসছে ভেবে। অন্য সময়ে হলে হয়তো চোখের
দেখাকেই মেনে নিতে হতো, কিন্তু এখানে চোখের দেখাকে হারিয়ে সামনে ফুটে এলো প্রযুক্তি।
পেনাল্টির বাঁশি বাজার সাথে সাথে র্যাশফোর্ডের দৌড় শুরু, সাথে সাথে শুরু ধুকপুকানি।
হৃদস্পন্দন আকাশ ছোঁয়ার আগেই জালে জড়িয়ে গেল বল। গোওওওওওওওওওওওওওললললললল..................
স্কোর ৩-৩। বাকি আর কিছু মুহুর্ত। শেষ বাঁশিটা বাজার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল এক বার ছুটে
যাই বুবাইয়ের কাছে, অঘোর ঘুমের মধ্যে ওর কানের কাছে চেঁচিয়ে বলি, ‘তুই আর স্বপ্ন
দেখ, আমি জানি তুই পারবি একদিন নিশ্চয়ই’।
এভাবেই হয়তো রূপকথা লেখা হয়। হয়তো সব রূপকথায় সেই
রাজা থাকে না, থাকে না সেই স্বপ্নের রানী বা পরী, কিন্তু কিছু রূপকথা হয় শ্রমিক শ্রেনীর
যারা মাঠে ঘাম ঝরায়,কিছু করে দেখায়। কিন্তু সেটা অনেকে পাতা উলটে পড়ে দেখে না সেই জৌলুস
নেই বলে। কিন্তু যারা ঘামের গন্ধ চেনে তারা সেগুলোকেই কাছে টেনে নেয়, আগলে রাখে
বুকের কাছে। এখানেও এভাবে একটা রূপকথা লেখা হলো, যেটা আমি দেখলাম; বুবাই দেখলো না,
হয়তো পরে শুনবে, হাইলাইটস দেখবে; কিন্তু মনে নিতে পারবে না। হয়তো এই রূপকথার কাছে থাকতে
পারলে ও আরো এগিয়ে যেত স্বপ্নের কাছে। স্বপ্ন হয়তো পূরণ হতো না কিন্তু স্বপ্ন দেখতে
তো শিখতো, সেটাই বা কজন শেখায় এই দেশে। এখানে তো সবেতেই রাজনীতি, স্বপ্ন দেখতেও হয়তো
একদিন ট্যাক্স দিতে হবে; কিন্তু বুবাই তো পারতো ততদিন স্বপ্ন দেখতে। তফাৎটা এখানেই
ওদের সাথে আমাদের। গ্রীনউড জানে ওই থ্রু বলটা ধরতে র্যাশফোর্ড এগিয়ে আসবে, কিন্তু
বুবাই জানে না ওই থ্রুটাকে কেউ আদৌ ধরবে কিনা। বলটা হয়তো গড়িয়েই যাবে...
[ম্যাচের কিছু মুহূর্তঃ-]
Khub sundor
ReplyDeleteosadharon lekha.. chaliye jao..khubb vlo..
ReplyDeletesundor r sohojvabe lekha, pore sottie bhalo laglo.
ReplyDeleteKhub valo laglo.... Keep up the good work...
ReplyDeleteOshadharon dada. Chaliye jan.
ReplyDeletebaah... darun lekha... mon chhuye gelo...
ReplyDeleteDarun likhecho dada!! Sottyii khub bhalo likhecho! But ball ta back e legechilo, thik haat e na!!
ReplyDelete