জানুয়ারি মাস,রাত্রি তখন ১.৩০। হসপিটালের ওই ডানদিকের
করিডোরটায় তখন হন্তদন্ত ছোটাছুটি। কিছুটা দূরে হলেও রিসেপশান থেকে আর্তনাদের হালকা
আওয়াজ ভেসে আসছে। এই পদদলনের আওয়াজ পেয়েই রিসেপশানের অ্যাটেন্ডেন্টটা তন্দ্রা
কাটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টায় মগ্ন। নার্স,আয়া, ওয়ার্ড-বয়,সিকুরিটি গার্ড মানে
মোটামুটি কাছেপিঠে যারা ছিল তারা সবাই জেগে উঠে বসেছে। আওয়াজ পরিস্কার না হলেও
কিছুটা আঁচ তারাও করতে পেরেছে। মুখে চোখে বিরক্তির সাথে কিছুটা বিস্ময়ও লেগে আছে।
মনে প্রশ্ন একটাই, “কেউ টপকালো না তো?”
লেবু কচলানোর ভঙ্গিমায় চোখ রগড়াতে রগড়াতে এক ওয়ার্ড-বয়
এগিয়ে গেল ওই ডানদিকটায়। বাকিরা কিছু বুঝতে না পেরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার
চেষ্টায় লিপ্ত হল। আওয়াজটা আস্তে আস্তে পরিস্কার হতে লাগলো। ঠিক ওই দিক থেকেই এক
ভদ্রলোক এই দিকে ছুটে আসছেন।
- ও দাদা, ও দাদা,
আপনি ওই বেড নাম্বার ১১৩-এর বাড়ির লোক না?
-
(ভয়,বিস্ময়,কিংকর্তব্যবিমূড় মুখে) হ্যাঁ ! হ্যাঁ ! দাদা আমি ওনার ছেলে।
- এত রাতে এত শোর
কিসের? কেসটা কি?
- কেস ! কিসের কেস
! (বিস্ময়)
- যাহ বাবা...!
আপনিই তো ছোটাছুটি করছেন। তাই বলছি ব্যাপারটা কি?
- ওহ। আমার একদম
মাথা কাজ করছে না। দাদা,কিছু সাহায্য করুন দাদা। আমার বাবাকে নাহলে আমি আর বাঁচাতে পারব না। (আগল ভাঙ্গা কান্না) একটা
কিছু করুন দাদা।
- আরে এরম করলে
হবে নাকি। আপনি শক্ত হন তবে তো ভালো কিছু হবে। এভাবে ভেঙ্গে পরলেই সব শেষ। যান
দেখুন কি করতে পারেন। কি রক্ত চাই?
- (অঝরে কাঁদতে
কাঁদতে) O –ve
নিজেকে সামলে ভদ্রলোক আস্তে আস্তে চলে গেলেন। হালকা চাপা
কান্নার আওয়াজও ভেসে এলো। এদের এসব গা সওয়া হয়ে গেছে,কারো আর কোনও প্রতিক্রিয়া হয়
না। সবাই আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল। শীতের রাতের চাদরমুড়ি
দিয়ে আবার ঘুমালো হসপিটাল, রেখে কিছু চোখের জল আর অসহায়তার আর্তনাদ।
********************
হসপিটালের ব্লাডব্যাঙ্কে ছুটে গেলেন
ভদ্রলোক। হসপিটালের ব্লাডব্যাঙ্কটা বেশি দূরে না,হসপিটাল চত্বরেই। হেঁটে এই মিনিট
তিনেক। সেখানেও খোঁজ চলল। এক প্রকার ঘুমন্ত কর্মচারীর কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়েই খোঁজ
চলল। এই ঘুম থেকে টেনে তোলা মানুষের থেকে বিরক্তি ছাড়া আর কি বা আশা করা যেতে
পারে?
- দাদা, ও দাদা O
–ve রক্ত আছে? এই দুই ইউনিট মত পাওয়া যাবে?
- (ঘুমন্ত স্বরে) কে এ এ এ এ এ...?
- দাদা,দয়া করে একটু দেখুন না,নাহলে আমার বাবাকে
আর বাঁচানো যাবে না।
- ধ্যুর শালা। যত আপদ এই রাত দুপুরে।
আলগা করে মাফলারটা সরিয়ে একটু
খোঁজাখুঁজি চলল। সেটা যে নেহাতই লোক দেখান সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও
ভদ্রলোক উৎসুক নয়নে চেয়ে থাকলেন,যদি কিছু সুরাহা হয়। ওদিকে যে সময় বেরিয়ে যাচ্ছে
সেটা খেয়াল করেন নি। বৃথা ১৫ মিনিট কাটিয়ে দেওয়ার পর একটা লম্বা হাই তুলে
কর্মচারীটা বলল
- না দাদা(লম্বা হাই),কিছু হবে না। ওই গ্রুপের
রক্ত আমাদের কাছে নেই। আছে তিন চার ইউনিট, কিন্তু সেটা আপনাকে দেওয়া যাবে না?
- কে...কে...কেন?? কেন দেওয়া যাবে না?
- আরে ধ্যুর্ মশাই। ওগুলো সব ভি.আই.পি দের জন্যে,আপনাকে ওই রক্ত দেওয়া যাবে না?
- আমরা ভি.আই.পি নই বলে কি আমাদের বাঁচার ও অধিকার নেই? (চোখে জল)
- এই রাত দুপুরে জোড় হাত করে বলছি আমার মাথা
খাবেন না। আপনি এখন আসতে পারেন। বেকার সময় নস্ট না করে দেখুন কোথা থেকে জোগাড় করতে
পারেন কি।(হাই তুলে)
তবে হ্যা,একটা উপায় আছে।
- কি? কি? কি উপায়?
স্বর্গের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত
খুশিতে ভদ্রলোকের চোখ দুটো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মনে মনে ঠাকুরের নাম নিয়ে কোন
ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় রইলেন।
- ব্যাপারটা হল কি আমি আপনাকে ব্যবস্থা করে দু
ইউনিট রক্ত দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু কাল সকালের ভেতরেই আপনাকে ওই রক্ত ফেরত দিয়ে
দিতে হবে,মানে রিফিল করে দিতে হবে। পারবেন কি? যদি পারেন তো ভেবে দেখতে পারি।
- হ্যাঁ পারব। আমি কাল সকালে যেখান থেকে পারি এই
দু ইউনিট রক্ত এনে দেব।
- ঠিক আছে আপনি মুচলেখা দিয়ে যান,নাহলে আপনার
এগেন্স্টে আইনি পদক্ষেপ নেব। আর হ্যাঁ, আমার নগদ ১০০০০ টাকা চাই।আসলে বুঝতেই তো
পারছেন এগুলো এমারজেন্সি কেস। বেআইনি ভাবে কাজ করলে কিছু তো লাগবেই। কোনও রশিদও
পাবেন না কিন্তু।
- যা হয় করুন, টাকা নিয়ে কিছু ভাব্বেন না। টাকা
আমি দিয়ে দেব,সুধু রক্তটা দিয়ে আমার বাবা কে বাঁচান।
- ঠিক আছে আপনি ৫ মিনিট দাঁড়ান,আমি ব্যাবস্থা
করে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক চলে গেলেন হসপিটাল সংলগ্ন
এটিএমে। কিছু টাকা তুলে আনলেন। যথারিতি রক্ত এলো। সুধার পাত্রের মত হাতে করে
ভদ্রলোক ছুটলেন রুদ্ধশ্বাসে সব পাওনা গন্ডা মিটিয়ে।
********************
এদিকে অবস্থা আরও শোচনীয়। যে অবস্থায় দেখে
গেছিলেন তার থেকে অনেক অবনতি হয়েছে। অপরিনত মস্তিকের যারা ছিলেন সাথে কিছু করতে না
পেরে অসহায়ের মত হাতড়েছে,আর ফোন করে গেছে অনবরত। কিন্তু ফোনের ব্যাটারি লো। সংযোগ
হয়নি একবারও। ভদ্রলোক এসেই মাথায় হাত। কি করবেন না করবেন ভেবে না পেয়ে ডাক্তার
ডাকতে ছুটলেন। ইনচার্জ ডাক্তার ছিলেন না,কাজে কাজে জুনিয়ারই ডেকে আনলেন। এক বারে
হইচই বেঁধে গেল। সকল কে বের করে ডাক্তার ঢুকে গেল ওই ঠাণ্ডা ঘরে। আবার সব কিছু
চুপচাপ,শান্ত শিথিল। মনের ভেতরে শুধু একরাশ দুশ্চিন্তা,উথকন্ঠা আর সাক্ষি ওই চোখের
জল। এক একটা মিনিট যেন কাটছে কয়েক বর্ষ ধরে। এই শীতের দিনেও ভদ্রলোকের মাথার ঘাম
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। কেমন একটা ভাগ্যের নিঠুর পরিহাসের বাতাবরন ধারন করেছে
ডানদিকের এই করিডোরটা।
বহুক্ষন
কেটে গেছে। প্রায় ৩০-৪০ মিনিট মত। কিন্তু এখনও ভিতর থেকে কেউ বেরয়নি। দুশ্চিন্তা
কেমন যেন কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে দিয়েছে ভেতরটা। অবশেষে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ভেতর
থেকে।
- ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু, বাবা কেমন আছেন? সব
ঠিকঠাক তো?
- মিঃ সামন্ত, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমি এই
যাত্রায় কিছু করতে পারলাম না। আপনার বাবা কোমায় চলে গেছেন। আই অ্যাম সরি।
রক্ত পেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখ
গুলো কেমন যেন আস্তে আস্তে নিথর হয়ে গেল। কোনও কোথা নেই, শুধু দু ফোঁটা জল গড়িয়ে
এলো। নিথর দেহ নিয়ে আস্তে আস্তে ওই করিডোরের চেয়ার গুলোতে বসে পড়লেন। আশেপাশের সেই
অপরিনত মস্তিষ্কের কাছে কাঁদা ছাড়া আর কিছু নেই। চোখের সামনেই কেমন যেন সব শেষ হয়ে
গেল। ক্রমেই যখন বাতাসটা ভারি হয়ে উঠছিল তখনি নিজেকে অনেক কষ্টে টেনে তুললেন মিঃ
সামন্ত। আই সি এউ –এর কাঁচটার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে চাইলেন বাবাকে। গয়নার মত কতো
যন্ত্র দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাবা কে। পরিস্কার করে কিছু বুঝতে পারলেন না। কেমন
যেন প্রানহীন একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন ওই দিকেই।
কতো
কিছুই বাকি রয়ে গেল। শেষ বারের মত কথাও বলা হল না । ঠাণ্ডা ঘরের ওই জানলা পেরিয়ে
তখন একটু একটু করে ঘাম জমতে শুরু করেছে। এই ছোট ব্যবধানটাই আজ ভরে নিলো কতো না বলা
কথা, কতো দুঃখ; আর দিয়ে গেল কয়েক কনা চোখের জল আর ওই কাঁচের দেওয়ালে জমা ঘামের
মধ্যে আলটপকা একটা হাতের ছাপ।
No comments:
Post a Comment