Friday, 26 January 2018

বইমেলার প্রেম





উঠতি বয়সের নেশাই হলো হুজুকে মাতা সে সরস্বতী পুজোর ভাসান হোক কি কিম্ভুত কিমাকার গানের ভাইরাল হয়ে ওঠা, হুজুগেই চলছে দুনিয়া বইমেলা যাওয়া এরমই এক হুজুগ কোনো বাঙালি আড্ডায় একবার মুখ ফস্কে বলে ফেলুন আমি বইমেলা যেতে পছন্দ করি না, পরের বার সেই আড্ডায় আর ডাকবেই না আপনাকে এটা আমি হলফ করে বলতে পারি আর শুধু বইমেলা যাওয়াই না, ব্যাগ বোঝাই করে বই না কিনে আনলে সেই বইমেলার কোনো মাহাত্ম্যই নেই সে বই পড়ুন না পড়ুন, ব্যাগ যেন ভরা থাকে বাঙালি হিসাবে একটু গর্বই বোধ হয় ওই ব্যাগটা দেখলে, মুখে চোখে কেতা কেতা ভাব, “দেখ কতো বই কিনেছি…!!!” এই চক্করে রাঁধুনি রাখা বাড়ির কর্ত্রীর হাতেওবেনুদির স্পেশাল ৫০ রেসিপিঘুরতে দেখেছি হুজুগটাই হলো আসল কথা


তো এরমই এক হুজুগের চক্করে গতবছর আমরা পাঁচ বন্ধু প্ল্যান করলাম বইমেলা যাবো বইমেলা তখন চলছে মিলন মেলাতে শুক্রবারে অফিস থেকে একটু জলদি বেরিয়ে চিরাচরিত ডাইনোসরের তলায় (যেটা এখন খুঁজলে আর পাওয়া যাবে না) হাজির হওয়ার কথা ঠিক বিকাল ৪টে ৩০ তো বন্ধু মহলে সাড়ে চারটে মানে সেটা অনায়াসেই পাঁচটা, আর বাঙ্গালির পাঁচটা মানেই সাড়ে পাঁচটা তো হিসাব মতোই সবাই জড় হলাম পাঁচটা পনেরোয়, একটু পাংচুয়াল বলতেই পারা যায় নর্মাল স্ট্যান্ডার্ড থেকে। সবই ঠিক ছিলো কিন্তু প্রবলেমটা হলো দলের মাথা পাঁচ থেকে ছয় হয়ে যাওয়ায়। এক বন্ধুর সাথে তার অফিসের এক বান্ধবী এসেছে। এতোক্ষন অব্ধি আমাদের জানা ছিলো যে দীপাঞ্জনের(ডাকনাম দীপু) কোনো ইয়ে কেস নেই, তবুও রিস্ক না নিয়ে একটু আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেই নিলাম,

-       ভাই, ব্যাপারটা কি?
-       কোন ব্যাপার নেই ভাই। অফিস কলিগ। তোরা কাজে লেগে যা। (হা হা হা)
-       আরেহ্‌, কাকা। করেছো কি তুমি, সেরা তো। (হা হা হা)

ব্যাস গ্রীন সিগন্যাল পেতেই আর থামাথামির সিন নেই, গড়গড়িয়ে চলছে গাড়ি। গেটের বাইরে চা খেয়ে সবাই মিলে মিশন বইমেলা, সাথে একটা সার্জিকাল স্ট্রাইক; মিশন পৃথা। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, মেয়েটির নাম পৃথা, পৃথা চক্রবর্তী। আলাপ পর্বেই জেনে বুঝে নিয়েছি, বাকিটা পরে দেখা যাবে।


মেলার ভিতর 


আগের কথা বলতে পারবো না, তবে হাল আমলে একটা কনসেপ্ট বেশ চলছে হাতে ইংরিজি বই, কানে ইংরিজি গান, মুখে ইংরিজি কথা আর সোশাল মিডিয়াতে ডিক্সেনারি ঘাঁটা ইংরিজি শব্দ দিয়ে একটা ইয়া বড় লেখা; ব্যাস মেয়ে পটে গেলো বলে বেশ বাজার ধরে নিয়েছে কিন্তু ব্যাপারটা অফিসে লোক ভর্তি লিফটে কান থেকে হেডফোন খুলে যদিলেট মি লাভ ইউশুনে ফেলে লোকজন তাহলে বুকটা দু ইঞ্চি ফুলে যাবে; “সনম রে, সনম রেশুনে ফেললে যাও বা মুখ দেখানো যাবে, “ভালোবেসে সখীশুনলে তো লজ্জায় মাথা কাটা, আর মুখই দেখানো যাবে না তাই রবি ঠাকুর থাক, মেয়ে পটে যাওয়ার পর না হয় ভাবা যাবে, কিন্তু ইম্প্রেস করতে গেলে এখন ইংল্যান্ড, আমেরিকারই পিছন ধরতে হবে এতোক্ষন যা যা বললাম এর সাথে বাস্তবের পুরো মিল আছে, আর আমিও এরই সাপোর্টার হাতে কলমে প্রমান পাওয়া গেছে

তোমেন উইল বি মেন সবাই মিলে লেগে গেছি কাজে, দেখা যাক কোন ছিপে মাছ ওঠে পৃথা বই পড়তে খুব একটা ভালোবাসে বলে মনে হল না, মানে বই দেখার আন্দাজ দেখে তো সেরমই মনে হলো অন্তত এদিক অদিক থেকে এটা সেটা বই তুলে দেখছিলো, আর মাঝের কিছু পাতাও উল্টোচ্ছিলো কি বুঝলো ভগবান জানে তবে আমার ওসবে মন নেই, বই দেখা তো পরেও থাকবে এখন খালি ইম্প্রেশ করার তাল এই স্টল ওই স্টল ঘুরে গাদা গাদা বই নিয়ে অনেক লম্বা চওড়া গল্প দিতে শুরু করছে সবাই আদিত্য, যে কিনা পাগলু, রংবাজ দেখে বড় হলো সে নাকি আজ কে গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর নিয়ে কথা বলছে মানে মেয়ে পটানোর জন্যে মানুষ কিভাবেই না লিমিট পুশ করে আমিও পিছিয়ে নেই; সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর উপন্যাসের বই উলটে দেখে না যে ছেলে, চেতান ভগত বা রবীন্দর সিং-এই যার দম আটকে অষ্টাশি তার হাতে নাকি দস্ত্রভস্কি, চার্লস ডিকেন্স ঘুরছে আর মুখে এমন একটা আঁতেল ভাব যেন বইটা ঠিক জমছে না জিনিস যেমনই হোক, প্যাকেজিং যেন ভালো হয়; সেই নিয়েই সবাই ব্যস্ত আমাদের তো তবু মানা যায়, সোহম তো আবার আকাশ ছোঁওয়া বানতলার অফিসে বসে আফ্রিকা, সাইবেরিয়া যাওয়ার গল্প বলছে এসব দেখে দীপু(পড়ুন দীপাঞ্জন) হাসিটা যে কি কষ্ট করে ধরে রেখেছে সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে

প্রায় ঘন্টা খানেক ফাঁকা কলসি বাজানোর পর বুঝেই গেলাম এই মাছ ছিপে ওঠার না তাই হাল ছেড়ে দিলাম একে একে সব কুপোকাত হয়ে প্যাভেলিয়ানে ফিরে আসছে প্রথমে আঁতেল, মানে আমি; এর পর সেন্সার বোর্ড, মানে আদিত্য; তার পর ট্রাভেল গাইড, মানে সোহম সোহম তো একবার কানে কানে বলেই ফেললো, “ এই মেয়েটার দাবিটা কি? কি যে চায় কিছুই বুঝতে পারছি নাকোনো কিছুতেই ইন্টারেস্ট নেইধুররর…” শেষমেষ বাকি রয়ে গেলো কুনাল লাল্টু চেহারা নিয়ে মেয়ে পটানোটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য ছিলো বা আছে তার কলেজে পড়ার পর থেকেই নিজের নামের পাশে এক্সট্রা একটা কথা জুড়ে দিলো কুনাল- অলয়েজ আ প্লেয়ারউহু, এই প্লেয়ার মানে সেই প্লেয়ার না, এই প্লেয়ার মানে সেইইইই প্লেয়ার এটা নিয়ে না হয় পরে একদিন কথা হবে

সব খেলোয়াড় একে একে সরে যাওয়ার পর শেষমেশ এলো কুনাল। বই পড়ায় বিশেষ ইচ্ছা টিচ্ছা নেই। কটা বই একটু উলটে পালটে নিয়েই শেষ বইমেলা দর্শন। এবার ক্রমশ তাড়া লাগাতে থাকলো খেতে যাওয়ার জন্যে। বইমেলাতে গিয়ে খাওয়া আর হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া অনেকটা একই রকম। তার উপর সাথে মেয়ে থাকলে তো আরই। যে বিরিয়ানি পাড়ার মোড়ে ৬০ টাকা নিলে অমুক, তমুক সবার বাবাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তার থেকেও খারাপ বিরিয়ানি ১৫০ টাকা দিয়ে গোগ্রাসে গিলবে বলে লাইন দিয়েছে সবাই। তো পেটের জানানে আর কুনালের তাড়ায় শেষ পর্যন্ত গিয়ে আমরাও লাইন দিলাম। কোথা থেকে কুনাল এসে পৃথাকে বললো, ‘ একটা নলেন গুড়ের আইসক্রিম খাবে?’ শুকনো নদীতে যেনো হঠাত বান এলো। চোখ গুলো যেনো খুশিতে ভরে উঠলো, একটা মিস্টি হাসি নিয়ে বললো,

-       হ্যাঁ, খাবো। কিন্তু বিরিয়ানির যা লাইন, কখন যে পাবো।
-       তুমি সিওর যে বিরিয়ানি খাবে?
-       না, আমার আসলে ইচ্ছা নেই। কিন্তু সবাই যখন...
-       সেটা কোনো ব্যাপারই না। আমারো আসলে ইচ্ছা নেই। তাহলে অন্যকিছু কি...
-       হ্যাঁ আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বাকিরা কি মানবে?
-       আরে বাকিদের কথা বাদ দাও তো। আমি আর তুমি বরং লাইন থেকে বেরই।
-       আর ইউ সিওর?
-       হ্যাঁ। এই দীপু আমি আর পৃথা একটু ওই দিকে গেলাম, তোরা একটু দেখে নে এদিকটা।


বলেই ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে ঢুকে গেলো, আর পাওয়াই গেলো না। ছোটবেলায় পাড়ার মোড়ের এক কাকু বলেছিলেন বন্ধুর ভালো হলে খুব ভালো লাগে, কিন্তু বেশি ভালো হয়ে গেলে আর ভালো লাগে না। আজ প্রমান পেলাম। বিরিয়ানিটা মুখে তুলতে এতো কষ্ট হচ্ছিল যে বলে বোঝানো যাবে না। ভাত, মুড়ি হলে তো ফেলেই দিতাম,কিন্তু বিরিয়ানি মা লক্ষী; তাই ওসব ভাবতে পারিনি, কষ্ট করেই ঘিটে নিয়েছি। খাওয়ার পর দেখলাম হাসাহাসি করতে করতে এগিয়ে আসছে কুনাল আর পৃথাবুঝেই গেলাম ফুলটসটায় টাইমিং ভালো হয়নি, ক্যাচ উঠে গেছে। আর কুনাল পিচ দেখে টেকে সুন্দর কভার ড্রাইভ করে রান করে নিয়েছে।  ফেরার পথে কুনালকে মনে মনে অনেক গালাগালি করার মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম,

-       ভাই কি করে পটালিরে মেয়েটাকে?
-       খেতে ভালোবাসে।
-       কি করে বুঝলি?
-       হুহু বাবা, এটাই তো এক্সপিরিয়েন্স।
-       ন্যাকামো না করে বল না...
-       আরে জাস্ট ব্লাইন্ড গেস। তোরা এতো বড় বড় ছাড়লি, জলও গললো না। তখন আমি ছোট দিয়েই ট্রাই করলাম।(হা হা হা) বেসিক নিড ভাই...
-       সে তো জামাকাপড়, মানে শপিং-ও হতে পারতো। সেটা কেনো বললি না?
-       এটা বুঝতে গেলে এক্সপিরিয়েন্স যোগাড় করতে হবে। তোর আকাঠ মাথা ঢুকবে না। (হাসি)

বাস থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরছি। দীপু নর্মাল, কুনাল মজায় আর আমরা বাকিরা যেন পরাজিত সৈন্য। এরই মধ্যে আমাদের সবার কাছে কুনাল বললো

-       এই তোরা সামনের সপ্তাহে আবার কোন প্ল্যান করিস না যেন, করলে কিন্তু আমি আসতে পারবো না।
-       (সবাই মিলে এক সাথে) কেন? তোর আবার কি হলো?
-       আরে, সামনের সপ্তাহে একটু বেরবো পৃথার সাথে। (লাজুকভাবে মাথা চুলকে)
-       (দীপু ছাড়া বাকিরা) ওহ। তা কোন চুলোয় যাওয়া হবে? 
-       একটু ফুডট্রেলে বেরোবো। আজ চলি। টাটা।

চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো মেয়েটাকে পটিয়ে, আর আমরা আমের আঁটি নিয়েই গড়াগড়ি খেলাম। তবে আমার সিক্রেট ডায়েরিতে লিখে নিয়েছি এই সব টিপস গুলো। দেখি কবে কাজে লাগে...


কুণালটা... শালা একটা প্লেয়ার বটে...!!  



No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...