Wednesday, 1 November 2017

দামিনী

।। এক ।।


- এই মেয়েটা আমার সাথে যাবি? গলির কোনের ওই ছোট্ট ঘরে, ঝিকিমিকি আলো জ্বালাবি; দারুন মজা হবে। যাবি যাবি?

- আজ পারবনি গো, শরীরটা আজ দিচ্ছে না। সকাল থেকে অনেক বার হয়েছে।

- শালা, বেশ্যা নাকি আবার হিসাব কষে দিচ্ছে, ন্যাকা শালা।

- সত্যি বলছি পারব নি গো, আজ শরীরটা আজ বয় নে।

- মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিসনে। অনেক টাকা গলিয়েছি তোর জন্যে। এতো বড়, ঢলঢলে গতর নিয়ে বসে আছে, আবার বলে দোকান খুলবো না। বেশ্যা মাগির আবার কথা শোনো।

- আজকের দিনটা ছাড়ো না গো, কাল সুদে আসলে উসুল করে দেবো।

- চল শালা, চল।

 পেশার কাছে হেরে যেতে হয়েছে সেদিন। হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলে গিয়েছিলো ওই গলির মোড়ের বাড়িটার তেতলার চিলেকোঠায়। টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় একটা আর্তনাদ আসছিলো খানিক দূর অবধি, কিন্তু রাস্তা মোড় নিতেই সব আওয়াজ বন্ধ। তেতলার ঘরে তখন চলছে প্রতিদিনের কাজের একটা রিহার্শাল। আর কান্না নেই, কোনো অভিমান, অভি্যোগ নেই; সব টুকু তখন জমা পড়েছে চোখের জলের সাথে। একটা বেশ্যার চোখের জলের হিসাব কেই বা নেয়…!! কাজ মিটলেই তো সবাই হাত ধুয়ে সাধু, মুখ লুকিয়ে মিলিয়ে যায় গলির অন্ধকারে। কিন্তু ওই কিছুক্ষনের জন্যে রাজা উজির উকিল সবাই সমান, কেউ পেশায় তো কেউ নেশায়।

আর ওই মেয়েটা? কেউ জানতে চায় না তার খবর। দিনে দিনে কষ্ট গুলো জমা হয় আর বিক্রি হয় টাকার কাছে। পেটের টান এমনই জিনিষ। শত আপত্তি স্বত্বেও “দোকান” যে তাকে খুলতেই হবে। এমনিটাই যে সমাজের বলে দেওয়া।

                   “ বেশ্যার আবার দুঃখ কিসের? ওরা তো টাকায় ভোলে…”



।। দুই ।।

ভিড়ে থিকথিক করছে বাস। সোমবার দিনের অফিস টাইম মানে বাকিটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না।  বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে, বাসের গেট, বাসের ভিতর; সব যেন থিকথিক করছে। মেয়েটা অফিস যাবে। বেসরকারি অফিসে চাকরি, একেই তো দেয় ওই কটা টাকা, তার ওপর আবার না যেতে পারলে কর গুনে বাদ পড়বে। তাই যেতে তো হবেই, সে যে ভাবেই হোক না কেন। প্রায় ১০-১২ মিনিট দাঁড়ানোর পর একটা বাস এলো, বাদুড়ঝোলা হয়ে। গেটে ঝুলে যাওয়া ছাড়া, লেট মার্কের হাত থেকে রক্ষে নেই। তাই উঠতেই হবে বাসে।

বাসের গেটের বাইরের জায়গাটা বড় ভালোলাগার জায়গা। কিন্তু সমূহ বিপদ, এই বুঝি হাত ছেড়ে যায়; এই বুঝি ধাক্কা লেগে গেল।তার ওপর আবার মেয়েদের ঝোলা বারন; দুর্বলের প্রতিমুর্তি হিসাবে যা ধরা দিয়েছে অনন্তকাল ধরে। সব কষ্ট দরজার বাইরে রেখেই ভেতরে ঢুকে আসতে হল, সব ভাল মন্দের বিচার না করেই। থিক থিকে ভিড় আর হাজার হাজার নিঃশ্বাসের মাঝে যেনো কোথাও একটা হারিয়ে গেছে মান সম্মান। এ কোনুই মারছে, তো ও কথা শোনাচ্ছে। কেউ আবার নোংরা ভাবে লোভ দিচ্ছে কিছু পাওয়ার আশায়। সুযোগ বুঝে কেউ আবার কেতাবি হালে কোমরটা একটু ছুঁয়ে নিয়েছে।

হঠাতই গেটের কাছের থেকে আওয়াজ এলো,

-ও দিদি, এই দোকানটা একটু সরান না। একাই তো আড়াই জনের জায়গা নিয়েছেন, আর কতোক্ষন এভাবে দাঁড়াবো?   
- সত্যি মাইরি, এই অফিসটাইমে কেনো যে মেয়েদের তোলে বাসে কে জানে। একাই দাঁড়াবে, আর কেউ দাঁড়াবে না যেন।

টিপ্পনিতো রোজকার ঘটনা, শুরু শুরুতে নাড়া দিলেও এখন গা পেষা হয়ে গেছে। ঘটনাটা একই কিন্তু মুখ গুলোই আলাদা। উত্তর দিতে মন চাইতো আগে, দিন দিন এ সেটাও আর নেই। সব উত্তেজনা ওই কানে গোঁজা হেডফোনটাই বয়ে নিয়ে চলে। চারি হাতের মধ্যে, আধ সেদ্ধ হয়ে মেয়েটা যখন অফিসে পৌছায় তখন হয়তো তার মান, ইজ্জত সব টুকুই ওই বাসের ভিড়ের মাঝে বন্ধক রেখে যায়, ইচ্ছার বাইরে গিয়ে, পেশার তাগিদায়।

কেউ কি আদৌ খবর নেয় মেয়েটি আজ ভিজে চুল মুছেছিলো কিনা? বা ভিড়ের মধ্যে কেউ কি তার পা টা মাড়িয়ে দিয়েছে?

                   “উহ, মেয়েদের আবার চাকরি করতে যাওয়ার কি আছে? ওটা তো বাড়তি ইনকাম”



।। তিন ।।

বিয়ে করে এনেছিলে ঘরে। চোখে লাগিয়ে ছিলে অনেক নতুন স্বপ্ন, সবই মেয়েলি স্বপ্ন। সেসবের প্রতি তোমার কোনও দায়িত্ব ছিলো না কখনো। তুমি শুধু শরীরের জন্যে আসতে আমার কাছে নেশায় মত্ত মাতালের মতো। প্রথমবার শরীর স্পর্শ করার সময় একরাশ জড়তা তোমায় অবশ করেছিল প্রায় ইতস্তত করেছিলে হাত বাড়াতে সেবার তুমি পারোনি আমায় ভোলাতে, আক্ষেপ ছিল বেশ অনেকখানি আদিম সত্যের হাতছানিতে পরের বারে অবশ্য সব হিসাব মিটিয়েছিলে সুদে আসলে। জড়তা কাটিয়ে ক্ষুধার্ত হায়নায় মতো, ঝাঁপিয়ে পড়েছো ওই ইঞ্চি মেপে চর্বি জমানো নাভির আশেপাশে, খানিকটা হাঘরের মতোই বলা চলে। খুব কানে লাগলো, তাই না? হ্যাঁ, হা-ঘরেই নেশার মতো বার বার কাছে আসতে চাইতে তুমি অমৃতস্বাদের খোঁজে কাছে আসা যাওয়ার মিথ্যে অভ্যাসে ভুলে আমি প্রেমে পড়েছি তোমার বোকার মতো

প্রথম প্রথম আঙ্গুলের ফাঁকে জমে থাকা ঘাম চেটে খাওয়া পোশাকি ভালোবাসায় আমি ভুলেছি,একবার না বারবার, নির্বোধের মতো অপরিণত ভালোলাগা গুলো বুঝতে দেয়নি একদিন ওই হাতের ঘাম মুছতে রুমালও ভিজে যাবে, কিন্তু অন্য কোনও হাত আর এগিয়ে আসবে না ক্রমেই হারিয়ে গেছি আমি ভালোবাসা থেকে এখন আর হাত ধরে বসে রোজকারের ওই প্যানপ্যানানি কথা শুনতে ইচ্ছা হয়না বারে বারে নোংরা ছুকছুকানি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে লোভীর মতো ওঁত পেতে বসে থাকো ওই অনুভুতির জন্যে এখন আর অনুভুতি আসেনা, অভ্যাস হয়ে গেছে কেমন তোমারও আজ কাল আর খিদে মেটে না তৃষ্ণা মেটাতে এখন পুরোটা লাগে মনের সব তৃষ্ণা এখন শরীরে চলে এসেছেশরীর ছুঁতে এই আকুলিটা বিরক্তিকে ডেকে আনতো, কিছুটা অধিকারের জন্ম দিয়েছিলো কুঁচকির আসে পাসে কাজ শেষ, আবার যে কে সেই বেড়েছে দূরত্ব, হারিয়েছে উত্তাপ, শীতের হাওয়ায় উলুবনে আজ মুক্ত ছড়াবারও কেউ নেই।

তোমার দেখানো এই ভালবাসা থেকেই নির্লজ্জের মতো একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা গুলো দিনের পর দিন ভাঙ্গা টেপের মতো কানের কাছে বলে যেতাম আমি তুমি শুনতে, কিন্তু উত্তর দিতে না অভিব্যক্তিই জানিয়ে দিতো বাকিটা যে ভালোলাগা কে প্রশ্রয় দিয়ে শুরু করেছিলে কাছে আসা, যে আঘাতে করেছিলে ঘায়েল,সেই আঘাত দিয়েই আবার আমায় একলা করলে আঘাত দিয়েই মনের জোড়া,  আঘাতেই ভাঙ্গন ; কোনটাতেই আওয়াজ হয়নি, শুধু একটু রক্ত ঝরেছিলো

অনেকখানি বদলে গেছি আমি। তুমি না বললে হয়তো বাকি থেকে এই ভালোলাগার জায়গাটা। তোমার কথা আজকাল মনেই পড়ে না নেশার মতো লক লক করে নাভির আসে পাশে যে চর্বি গুলো চেটে বেড়াতে সেগুলোকেও বিদায় দিয়েছি আমি নিয়ম করে জিমে যাই, ঠিক যতটা নিয়ম করে রোজ সকালে স্নানের পর সিঁথিটা  রাঙ্গিয়ে তুলতাম জানি না তুমি কেমন আছো, তবে নির্ঘাত সেই লেনা দেনার কারবারেই মন দিয়েছো। করো করো, ওটা তোমারই হবে। (হাসি)

আমি সেদিন পারিনি যুঝতে এই সমঝোতার সাথে। দিনে দিনে জমতে থাকা মানসিক ক্ষতের কাছে দেনা পাওনা মিটিয়ে আমি সরতে চেয়েছিলাম। মাথার কালসিটে তবু সেরে যায়, মনের হ্যামারেজের যে কোনও টিংচার আয়োডিন নেই। আমি পেরেছি মনের ব্যাথায় অসুধ দিয়ে গলা সাধতে, আরো হয়তো অনেকে আছে যাদের রোজ রোজ সম্মান বেছতে হচ্ছে ৬-৭ টাকার হিসাবে বা কোনো এক অন্ধ গলির শেষে এক মিথ্যে স্বপ্নের কাছে। যুদ্ধ সবার আছে, কেউ তরোয়াল ধরে, কারো হাতে রাইফেল ;কেউ দাঁড়িয়ে নিষিদ্ধ পল্লীর মুখে কেউ আয়নার সামনে।

যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবে। নাই বা ঝরলো রক্ত, নাই বা হলাম বলি। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী।।  



5 comments:

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...