এই বাংলার বুকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে এই মাতামাতি সবই হাল
আমলের ব্যাপার। কয়েক বছর ধরেই এসব শুরু হয়েছে, কিছুদিন আগেও এসবের কোনো ইয়ত্তা ছিল না। হাল আমল বলতে ওই ধরুন দশ-বিশ বছর হবে। তার আগে অব্ধি বারান্দাতেই থেমে যেত অদম্য সব প্রেম গুলো। বারান্দা আর উলটো দিকের বাড়ির বাঁধানো রক, আহা কতোই না
স্বপ্নের জাল বুনেছে তার কোনো হিসাবই নেই। হঠাত আপনার মনে হতেই পারে
শাহজাহান-মুমতাজ, সংযুক্তা- পৃথ্বীরাজ, রোমিও- জুলিয়েট এরা তো সব লেজেন্ডারি ক্যারেক্টার এই প্রেমের ফিল্ডে, তাহলে আমি কেনো
বলছি ভ্যালেন্টাইন্স ডে এরম নতুন কনসেপ্ট। দেখুন, এই ভ্যালেন্টাইন্স
ডে আসলে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদিন হিসাবে পালন করা হয়। প্রেমের বানি, প্রেমের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা কররে করতে তিনি মারা যান। আজ কাল কার ছেলে মেয়েরা ভীষণ সেয়ানা, কেউ যে কারো
না সেটা তাদের থেকে ভালো কেউ বোঝে না। তাই কারো জন্যে জীবন দেওয়াটা
একটা ওয়েস্টেজ, সেটা আলাদা করে আর বোঝাতে হয় না। তাই ওই একটা দিন একটু অভিনয় করে নিতে পারলেই এখন নিশ্চিন্ত কটা
মাসের জন্যে। গোটা দুনিয়াই এই থিওরিতে চলছে, আমরাও চলছি।
তো
একটু আগে যেটা বলছিলাম। হ্যাঁ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে। কয়েক বছর আগেও এই দিনে চারদিকে
ঢি ঢি পরে যেতো। আর সাথে এই হারামজাদা আর্চিস। পেল্লাই দোকান গুলো এমন ভাবে সাজাবে
যেন ওসব লালরঙ্গা কার্ড গুলোর সাথে সাথে বালিশ,টেডি, আর যা যা হয় সব দিয়ে দেবে কম
পয়সায়,সাথে ভালোবাসাটা ফ্রি। যত্তসব। মানে ভাবুন আমাদের মত হাফ-প্যান্ট পরা
মধ্যবিত্ত ঘরের স্কুলে যাওয়া ছেলেদের কথা গুলো, যাদের কাছে টিফিন
বলতে স্কুলের গেটের ঘুলঘুলি দিয়ে হাত বের করে দু টাকার আলু-কাবলি কি কারেন্ট
নুন দেওয়া কালো কুলের আচার; অথচ পিছন পেকে একেবারে মনে বসন্ত ঘনিয়ে এসেছে( কি ভাগ্যিস পক্সটা
হয়নি) তাদের অবস্থাটা।লাল ঝোল ফেলে তো আর্চিসের দোকানের নোংরা দেওয়ালটা পরিস্কার করে
দেবার উপক্রম। কিন্তু কি আর করা যাবে, উঠতি ট্রেন্ড
আর সাথে অফুরন্ত পুড়কি; তাই এসব ব্যাপার তো খানিক অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিলো বা উঠেছে
এই হাল আমলে। বিদেশি আদব কায়দা কপি করার মধ্যে কেমন যেন একটা পরমাত্মিক সুখ
আছে, সেটা এখন বুঝতে পারি। আগে তো দেশের মাটি,দেশের মাটি করে
অনেক জ্ঞান ঝেড়েছি, এখন দেখি ডুগডুগি নিয়ে বাউল গানের থেকে ঝুঁটি বাঁধা
বেসুরো গিটারের কদরই বেশি। তাই সই, বিদিশি ব্যাপার
বলে কতা… J
তা এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে বললেই একটা দারুন ঘটনা মনে পড়ে। তখন ওই ক্লাস নাইন কি টেন, মানে মনে সবে
রঙ লাগা শুরু হয়েছে আর কি। বাড়ির লোকের কড়া নজর, ছেলেটা এই বুঝি পিছলে গেলো। মানে পারলে কোচিং-এর বাইরেও দাঁড়িয়ে
থাকে। কোচিং থেকে ছেলে বেরোবে
আর বগল দাবা করে নিয়ে ছুট।প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার ছোট থেকেই বয়েজ স্কুলে পড়েছি, তাই মেয়েদের
প্রতি আকর্ষনটা একটু বেশিই। তবে নারীসঙ্গ যে একেবারেই
পাই নি এমন ভাবাটা ভীষণ ভুল ব্যাপার। আসলে আমরা এমন সময়ে বড় হয়েছি
যখন কোচিং-এ মেয়ে আর ছেলে একসাথে পড়াটা বেশ কিছুটা সহজাত হয়েছে। যদিও কোচিং-এর বাইরে আমাদের সার সার দাঁড়ানো ‘হিরো-ক্যাপ্টেনের’ পাশে পেল্লাই
পেল্লাই সব সুযুকি সামুরাই,বাজাজ ডিস্কভার এসব থাকতো(পড়ুন মেয়ের বাবাদের), তবুও কোচিং-এর ভেতরে তো
কেউ আর নাক গলাতো না,তাই বেশ খানিক সুবিধাই হতো। কোচিং শেষ হওয়ার পরেই তো সব চলতি কা নাম গাড়ি, তাই ওই টুকু সময়েই
কাজ গুছানোর পালা। খুব অবাক লাগতো একটা জায়গায়, যে মেয়েটাকে
সব থেকে ভালো দেখতে,ঠিক তারই পিছনে অন্ততপক্ষে গোটা ছয় সাত এবং কাকতালীয় ভাবে সেই
মেয়েটির বাবা বা কোনো এক দাদার রয়্যাল এনফিল্ড বাইক আছে। ব্যাস যেমনি বুঝলো গলতি,দাদা বাজালো ঘন্টি। ব্যাস ওই গাড়ির আওয়াজ শুনেই আমরা ফিউস। লিস্ট ছোট হয় গেলো একটু।
এই
টিভি, রেডিও আর সোনার দোকানগুলোর জ্বালায় আমাদের সেই সময় টেকা একপ্রকার দুর্বিষহ
হয়ে পড়েছিলো। মানে কোথায় ভাবতাম মা বাবা মনে রাখবে না দিনটা, আমরা নিজের মত কাজ
সেরে বেরিয়ে যাবো। কিন্তু না, আপনার পথে বাধা ওই অঞ্জলী জুয়েলার্স, সেনকো, পিসি
চন্দ্র আরো কত কি। এই ডিস্কাউন্ট, ওই ডিস্কাউন্ট মানে যতক্ষন না মাথার ঝিকুর নড়ে
যাবে ততক্ষন বাজতে থাকবে। আমার মনে পড়ে ওই দিন কলেজ যাওয়ার জন্যে নতুন জামা বার
করতে বললে মা কেমন একটা বাঁকা চাউনি দিত, তারপর ঠিক আলমারি খুঁজে সব থেকে জঘন্য
জামাটা বের করে আনত। কিছু বলতে গেলেই সেই পেটেন্ট ডায়লগ, “দিন দিন তো দেখছি ভাবন
খুব বাড়ছে। এতো সেজে গুজে কলেজ যাওয়ার কি আছে? আর যদি জেতেই হয় তাহলে নিজে খুঁজে
নে আলমারি থেকে...” এই ঠিক এই কথাগুলোই শুনে এসেছি বছরের পর বছর। মা খুব ভালো করেই
জানে আলমারি খুঁজে বের করাটা ঠিক কতটা চাপের কাজ,তাও আবার কলেজ যাওয়ার তাড়ায়। তার
পর যদি বের করেও পরেও নি সারাদিন বাড়িতে কিন্তু একটা চাপা উত্তেজনা চলতে থাকবে এই
নিয়ে যে আমি আজ বুঝি কলেজে বিয়েটা সেরেই নিলাম। ওসব দিব্যি টিব্যি আমি মানি না,
তবুও সব কিছুর দিব্যি দিয়ে আমি বলছি নিজের লুকের ওপর এতোটা কনফিডেন্স নেই যত মায়ের
আছে। মানে আমি আজ অব্ধি বুঝে পেলাম না মা কি করে ভেবে নেয় এই রকম একটা লুক নিয়ে
মেয়েরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যাই হোক, মায়েদের তো বুঝিয়ে পারা যাবে না। তবে
দেখতাম ওই দিনটাতে মেয়েগুলো বেশ সেজেগুজে আসে। ওদের মায়েরা কিছু বলেও না, বেশ
খুশিখুশি চলে আসে। কি আর করবো পোড়া কপাল।
ওই ২০০৬-০৭ সাল করে, তখন আমরা কলেজে সেকেন্ড
ইয়ার। হাতে তখন সবে সবে ফোন এসেছে,বেশ অনেক যুদ্ধ করেই। প্রায় চার হাজার টাকা দিয়ে
একটা সিক্যুরিটি ডিভাইস নিয়ে বাবা আমার কাছে এলো, বললো “এই অব্ধি আমার কাজ শেষ,
এবার বাকি কিকরে চালাবি তুই বুঝে নিবি। আমি আর কোনো দ্বায়িত্ব নিতে পারবো না।”
বলেই আমার হাতে নোকিয়া ১১০০ ধরিয়ে দিলেন। আনন্দে তো আমার ঘুমই হলো না। সাদা কালো
ফোনও যে কাউকে এতো আনন্দ দিতে পারে সেটা সত্যিই অবাক করে দেবে এখনকার ছেলেদের। তা
তার সাথে সাথে হাচের একটা কানেকশান। নাম্বার চালাচালি হয়ে গেছে যথারীতি। এবার
অপেক্ষা শুধু মেসেজ কার্ড ভরার। ওই ৩০ টাকার জন্যে কতো দিন যে উপোস করতে হয়েছে সে
আর বলার নয়। যাই হোক এভাবেই শুরু। তো আমাদের স্কুলের বন্ধুদের একটা বিশাল গ্রুপ
আছে। তো সেই গ্রুপেই প্রথম বউনি করলো
সুগত। বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড, আরি শালা কি এক্সাইটমেন্ট আমাদের, যেনো নিজেদেরই
জুটেছে এক একজন করে। সুগত দেখতে শুনতে তো নো ডাউট ভালো, যদি আপনারা কোনো উপমা আশা
করে থাকেন তাহলে সেটা পুরন করতে পারলাম না। ধরেই নিন না, খুব ভালো দেখতে; তা নাহলে
রামকৃষ্ণ মিশন মার্কা বন্ধু সার্কেল থেকে কেউ এরম অমর-প্রেমি হতে পারে?? সবই ঠিক কিন্তু
আসল প্রবলেম হলো একটা। সু...সু...সুগ...গত একটু তো...তো...তোতলা। মানে ওই একটুই আর কি,এই একটু। তবুও সে তখন আমাদের আইডল। প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সে কি উত্তেজনা...আমাদের অনেকটাই বেশি ওর থেকে। তো আমাদের
একটা বাড়তি দ্বায়িত্ব এসে পড়েছে। সুগতর বৈতরণী পার করাতেই হবে। আমরা চাঁদা তুলে...হ্যাঁ চাঁদা তুলে আর্চিসে
গেলাম। একটা ভালো দেখে কার্ড কিনে, তার ওপর আরও মশলা মাখিয়ে যথারীতি পাচার করার
ধান্দায়,সাথে একটা মিথ্যে কথা ভরা লাভ লেটার।
ভাবনা ও রুপায়ন সৌজন্যে অবশ্যই আমি। মানে কোনো কারনে যদি কোনো কেস খাই
তাহলে প্রথমেই কোপ পড়বে আমার ওপর।
যথারীতি
সময় মতো দেখা করতে যাওয়া। লোকেশান হিসাবে পড়েই আছে বাঙ্গালির সাধের ভিক্টোরিয়া। এই
সব উঠতি প্রেমিক প্রেমিকাদের অনন্ত ঢপের ছাপে ভিক্টোরিয়ার সাদা দেওয়াল কালো হয়ে গেলো বলে। সে যাই হোক, সুগত গেছে। ইম্প্রেশান জমাতে একটা গোলাপ, আর বেপাড়ার একটা
চকলেটের দোকান থেকে বন্ধুর নামে ধার করে কেনা ২০ টাকার ডেয়ারি মিল্ক। গোলাপ কিনতে
গিয়ে তো আর এক কেচ্ছা। ওই বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম থেকে সেন্ট পলস এর দিকে আসতে ওই
জায়গায় বেশ কয়েক বাচ্ছা এই দিনে অনেক গোলাপের পশরা সাজিয়ে বসে। তো সেখান থেকেই
হৃষ্টপুষ্ট একটা গোলাপ তুলতে গিয়েই প্রথমে হোঁচট সুগতর।
- এই গো...গো...গো...লাপ...লাপটার
দা...দাম কতো রে??
- ৫০
- কি...কি ব...ব...বলছিস??
- বললাম তো, ৫০ টাকা। এর থেকে কম
হবে না।
- সে কি রে...
- নেওয়ার হলে নাও, নাহলে সামনে
যাও।
(সঙ্গে সঙ্গে ফোন)
- ভা...ভাই... বলছি...বলছি এখানে
গো...গো...গোলাপের দাম বল...বল...বলছে ৫০ টা...টাকা। কি...কি করবো বল তো?
- যা পাচ্ছিস কিনে নে। এতো ভাবলে
চলে না।
সে যথারীতি কিনে নিয়েছে ভাল
মানুষের মত। কিনে নিয়ে সোজা ভিক্টোরিয়া। ওদিক থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে রিম্পা।একটা
হাসি বিনিময়, তার পরে ভিক্টোরিয়ার ভেতরে প্রবেশ। বাকিটা না হয় থাক। বাকিটা
ব্যক্তিগত। তো এই ছিল প্রথম ভ্যালেন্টাইন্সডের সেলিব্রেশান। মানে সুগতর
সেলিব্রেশান, কিন্তু আমরা এতোতাই নিবেদিত প্রেন যে আমরা কিছু কিছু ভাগ করে
নিয়েছিলাম। ডুয়েল মিনিঙ্গের কথা ভেবে অনেক বাঁকা হাসি দেখা গেলেও ব্যাপারটা একদমওই
সেরম না। আমি অত্যন্ত সাদা মনে(কাদাটাকে লুকিয়ে) কথাটা বলেছি।
এর
প্রায় বেশ অনেকটা দিন পরে খবর এলো যে সুগতর নাকি ব্রেক-আপ হয় গেছে। এই একটা জায়গায়
আমার ভয়ানক আপত্তি আছে। যদি না ভালোবাসারই থাকে তাহলে ওই ১৪ তারিখ পালন করার
মানেটা কি? যে প্রান বাঁচবেই না তার জন্যে জন্মদিনের কেক কাটার মানেটা কি? এর থেকে
ওসব বিলিতি কায়দা ছেড়ে, ওই একটা দিন কে আলাদা করে ভালো না বেসে প্রতিদিন
ভালোবাসলেই তো আর আর বেঘোরে মরতে হয় না এই রিলেশানগুলোকে। একটা দিন না, প্রতিদিন যদি ভ্যালেন্টাইন্স ডে
হয় তাহলে ক্ষতি কি??
বিঃ দ্রঃ- উপোরক্ত (শেষ প্যারায়) কথাগুলো গোবেচারা,নিরীহ,
নিপাট ভালোমানুষ একটা “সিঙ্গেল” ছেলের একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। তাই এর সাথে
বাস্তবের কোনো মিল থাকলে সেটা একদমই অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
এর পর আর কেউ বিশ্বাস করবে আমার
কথা গুলো...
আমি
সিঙ্গেল তাই এতো বানী দিয়ে চলছি আপনাদের। আমার ফাটা কপাল জোড়া লাগলে আমিও হয়তো তাই
করবো। আসলে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন। তখন না হয় আর এক চোট আড্ডা দেওয়া যাবে।
ততক্ষনের জন্য ভালো থাকুন, ভালো রাখুন আর ভালো বাসুন।
*************************** সমাপ্ত
***************************