Saturday, 29 December 2018

কি শুনতে পাচ্ছেন???





“শিল্টনের হাতেই এবারে মরসুমের প্রথম ডার্বি জয় এলো বাগানে…”

কথাটা শুনে একটা চওড়া হাসি নিয়ে টিভিটা বন্ধ করলাম। ডার্বি, শনিবার বিকাল আর সাথে আকাশের রঙ সবুজ মেরুন এর থেকে আর ভালো কম্বিনেশান কি বা হতে পারে...!!! এখন খেলার পরেই প্রধান কাজ হলো ফেসবুকে ঘুরে আসা, কোথাও কোথাও তুমুল তর্কের আগুন লাগলে একটু করে ঘি ঢালা, তার পরে বাছা বাছা কিছু ছবি নিয়ে সোজা শেয়ার, বা ওয়াটস্যাপ স্টেটাস; ব্যাস আর কি গর্বিত সমর্থকের মতো কাজ শেষ। তবে মনে মনে দুঃখ রয়ে গেল, ‘ইসস কাল যদি অফিসটা থাকতো তাহলে বেশ রগর করা যেত। এই ভাবতে ভাবতেই একবার ফেসবুকে গ্রুপ গুলোয় ঢুঁ মারলাম। দেখলাম রীতিমত ঝামেলা চলছে। কিছু ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের দাবি মোহনবাগান রেফারি কিনেছে, আর সেই কথায় বেশ কড়া রকমের গালাগাল চলছে। এ আর নতুন কি, আমরা মানে বাগানীরাও হেরে গিয়ে সেই এক কাজ করি। কম বেশি সব জায়গার ডার্বি নিয়েই এক রকম ব্যাপার হয়ে থাকে, আর ফুটবল তো আমাদের রক্তে; এসব তো হবেই।

আসল অসুবিধাটা এখানে না, অসুবিধাটা হলো এর পরে। কিছু ম্যাচ জিতে গেলাম, কিছু ম্যাচ হারলাম, লিগ পেলাম না, কিন্তু ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছি এটাই সারা মরসুমের ব্যালেন্স-শিট। না পেতে পেতে, পেতে চাওয়ার অভ্যাসটা আসলে আমরা সমর্থকরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন কথা আসতেই পারে এই তো সেদিন জাতীয় লিগ জিতলাম প্রায় তেরো- চোদ্দ বছর পরে, তার পরের বছরেই আবার ফেড-কাপ, এবছরে আবার কলকাতা লিগ পেলাম প্রায় আট বছর পরে; এরপরেও এতো কথা কেন থাকবে? সত্যি সেটা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু দুবার কেন ফিরে এলাম দোরগোড়া থেকে? কে এই আইজল, কে এই মিনার্ভা, তারা কেন এগিয়ে থাকবে আমাদের থেকে? এটার কি কোন উত্তর আছে কর্তা মশাইদের কাছে? এখন যদি প্রসঙ্গ টেনে আনা হয় যে লেসটারও তো লিগ জিতেছিল সেখানে তো সবাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল এখন কেন প্রশ্ন তুলছি? সেই উত্তরে বলবো অঘটন একবার হয়, দু বার হয়। বার বার হয় না। সেখানে মোহনবাগানের মতো দলের লিগ জিততে সময় লাগলো চোদ্দ বছর, কলকাতা লিগ জিততে সময় লাগলো আট বছর। তাহলে মাঝের এতোগুলো বছর কি শুধুই অঘটনই হয়ে চলছিল?

আমরা ভারতীয়রা খুব অদ্ভুত। নিজেদের অপমান সুন্দর গলা ভিজিয়ে গিলে নিতে পারি যদি বাইরের কেউ আমাদের থেকে পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে বেশি অপমান করে। ময়দানেও সেই এক হাওয়া, ‘মোহনবাগান কাপ পায়নি তো কি আছে, ওরাও তো পায়নি; আর কলকাতা লিগটা কোনও লিগের পর্যায়ে পড়ে নাকি।’ এসব তো আমাদেরই বানানো কথা পিঠ বাঁচানোর জন্যে, লজ্জা ঢাকার জন্যে। কিন্তু এটা কি আদৌ কাম্য মোহনবাগানের মতো একটা দলের কাছ থেকে? চোখের সামনে তরতরিয়ে বেঙ্গালুরু এফসিকে মাইল খানেক এগিয়ে যাতে দেখেও কি কর্তাদের টনক নড়লো না? কেন নড়লো না? যেহেতু নামটা ইস্টবেঙ্গল না, সেই জন্যে? আর যদি ইস্টবেঙ্গলের কথাও ধরি সেখানেও তো ওদের নামের আগে কিংফিশার বা কোয়েশ(নতুন) জুড়েছে? আমাদের ক্লাবের সাথে তো কিছুই জুড়লো না, সেটার দিকে কি কারো দেখার সময় নেই? এখনো যদি সময় না হয় তাহলে কবে হবে আর?

না আছে ভালো রিক্রুট, না আছে ট্রফি, না আছে ভালো ব্যবস্থা, না আছে কোন তাগিদা; এভাবে কোনোদিন মোহনবাগান খেলেছে? আমি অন্তত এভাবে খেলতে দেখিনি কখনো। এতোদিন ধরে ক্লাবে কোনো স্পনসর নেই, এতোদিন ধরে এক কর্তার বা বলা যায় কিছু কর্তার টাকায় প্লেয়াররা বেতন পেয়েছে। খুব ভালো কথা, কিন্তু সেই ভাঁড়ে আর কতোদিন চলবে? এক সময় তো খুচরো গুলোর আওয়াজ শোনাই যাবে। সেটা জানা সত্ত্বেও কোনও প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে এই ক বছরে কিছু মিথ্যে খবর ছাড়া? নতুন আবার খবর এসেছিল সাড়ে তিনশ কোটি। সেটার সত্যতা যাচাই করতে গিয়েই ভাঁড়ে মা ভবানী। কিছু না পেয়ে চারশো কোটির সাথে পাল্লা দিয়ে সাড়ে তিনশো গচিয়ে দিলেন? না এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে পুরোনো দিনের জমানো কাটমানি গুলোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন কর্তারা?

ধীরেন দের মোহনবাগান বলত, ‘মোহনবাগানে কোন বিদেশী খেলে না’। নিজের মাটির ছেলেদের ওপর এতোটাই আস্থা ছিল তাঁর। সেই রীতি এখন নেই, সেটা আশা করিও না; কিন্তু ঢাঁক ঢোল পিটিয়ে যে বিদেশিকে বছরের পর বছর আনা হচ্ছে সে তো আসল ম্যাচ খেলছেই না, তাহলে কি লাভ? কারন খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে পেমেন্ট পায় নি বলে খেলবে না। এর থেকে লজ্জার কথা আর কিছু হতে পারে? বছরের পর বছর হতশ্রী বিদেশি, আর ততধিক বাজে দেশি রিক্রুট, যে টিমটাকে একটা একশ ওয়াটের বাল্বের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলে হাড় গিলে কঙ্কাল দেখা যাবে। খেলাত চোখে দেখা যায় না এতোটাই বাজে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে নির্বিকার কর্তারা। বলি এতো নাটক করে, মিথ্যে স্পনসরের গল্প ফেঁদে,   খবরের শিরোনামে এসে তো ভোটটা জিতলেন এবার কি গল্প হলেও সত্যি কিছু হবে? নাকি আবার কপালে আমড়ার আঁটি?

টিমে আগে বাঙালি খেলতো না, এখন সেখানে অনেক বাঙালি দেখতে পাই। কারন বাকিরা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আই-এস-এলে চলে গেছে। আর যাবে নাই বা কেন? সেখানে পয়সা সেখানে ছোটাই তো প্রবৃত্তি মানুষের, আপনাদেরও তো তাই। এখন যারা খেলছে তাদের খেপের মাঠেও নেবে বলে সন্দেহ আছে।আর এদের দোষ দিয়েই বা কি লাভ ক্যান্টিনে খাবার পাওয়া যায়? একটা জিম আছে? যে মোহনবাগান অ্যাকাডেমির নাম সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিল সেখান থেকে আর একটাও সাড়া জাগানো তারকা বেরোচ্ছে না কেন? সেদিকে কখনো খেয়াল করেছেন? খালি ব্যাগ ভরেছেন নিজেদের আর জাতীয় ক্লাবের তকমা গায়ে মেখে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

এতো কথা কেন বললাম জানেন কারন আমরা মোহনবাগানকে ভালোবাসি। মায়ের মতো জায়গায় রাখি মোহনবাগানকে। মাঠের সাথে যোগাযোগ একদম নেই বললে ভুল বলা হয়। মাঠে আমিও নেমে পড়ি সময় পেলেই, কোনো পেশার তাগিদে না, খেলাটার প্রতি ভালোবাসার জন্যে। বললে বিশ্বাস করবেন কি জানি না আমার কাছে এখনো দুটো জার্সি আছে খেলার। এক্ষণ সব রংচঙে বিদেশি ক্লাবের জার্সি পরে খেললেও আমার গায়ে কিন্তু এখনো সেই সবুজ মেরুন। নিজে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত হয়েও বাড়িতে কখনো ওই জার্সি ঢুকতে দিই নি। কারন আমি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ফ্যান, আর মোহনবাগানের সমর্থক, মোহনবাগান আমার ভালোবাসা। তাই ওই ক্লাবের সাথে সাথে আমাদের এগিয়ে চলাটাও অনেকটা নির্ভর করে। আজাহার একটা দূর থেকে শট নিলে মনে আশা জাগে, ডিকা একটা বাজে মিস করলে রাগে মুখে গালাগাল চলে আসে, সোনির একটা ছোট্ট টাচে হৃদয় নেচে ওঠে আর পিন্টুর ওই উইনিং গোলে এক ঝলক নেচে উঠি আমরাও। এসব গুলোর দিকে যদি এখন না দেখেন তাহলে হয়তো আর কখনো দেখবেনও না। নিজে এখন কাজের সূত্রে বাইরে থাকি, কিন্তু ব্যাগের মধ্যে এখনো দুটো পতাকা ভরা আছে। একটা ভারত মায়ের আর একটা মোহনবাগানের।

কি শুনলেন তো? হ্যাঁ কর্তা মশাই, আপনাদেরই বলছি। ঠিকই বুঝেছেন। এসব গুলো একটু দেখুন নাকি এবার। অনেক তো হলো, একটু নড়ে চড়ে বসুন এবার। আজ তাহলে এখানেই থামলাম। যেতে যেতে একটা কথা বলে দিয়ে যাই, আজ কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে, আমরা জিতিনি বটে, কিন্তু ওরাও ড্র করেছে। তাই এক পয়েন্ট বেশি পেয়েছে আমাদের থেকে। তাই খুব একটা চিন্তার কিছুই নেই। শুধু মোহনবাগানের লেভেলটা অনেক খানি নেমে গেছে, আগে নিজেরা ট্রফি পেলে খুশি হতাম, এখন ইস্টবেঙ্গল না জেতায় খুশি হই। এই তো, এই যে স্বস্তির হাসি দেখলাম আপনাদের মুখে এটাই তো পাওনা... J

                                                ।। জয় মোহনবাগান ।।





No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...