Sunday, 15 July 2018

স্বপ্নের উড়ান




এখন আমার এসি ছাড়া ঘুম হয় না। অফিসে সারাদিন এসিতে থাকার পর অপেক্ষায় থাকি কখন বাড়ি ফিরে এসিটা একটু চালাব। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথটাও এসি বাসেই কেটে যায়, বিরক্তির জায়গা শুধু ওই বাসস্টপ থেকে বাড়ির দোরগোড়া অবধি পথটা। কলকাতার প্যাচ প্যাচে গরম নিয়ে হাজার অভিযোগ জমা হয় ওই পাঁচ-দশ মিনিটের হাঁটা পথটায়। এক নিশ্বাসে উগরে দি বাড়ি ঢুকেই। স্বভাবের দোষে এখন আর নন এসি বাসে যাতায়াত করতেও পারি না। সেদিন বাড়ি ফিরে নিত্যদিনের অভ্যেস মতোই ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পরে, স্নান সেরে যখন এসিতে ঢুকলাম, মনে হল যেন দুনিয়ার সকল সুখ ওখানেই আছে। জলদি খেয়ে দেয়ে নিয়ে বিছানায় শুধু গড়িয়েছি মিনিট দশ পনেরো হলো, অমনি টুক করে কারেন্ট অফ। মনে হল যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। উগরে দেওয়া ক্ষোভ যেন নতুন করে জন্ম নিল আবার, মুখ দিয়ে স্বতোতসারিত ভাবে বেরিয়ে এলো, “ধুর শালা, এখনই যেতে হল…!! এবার আমি ঘুমাবো কি করে?” মানুষ এভাবেই অভ্যাসের দাস হয়ে যায়। সেদিন আর ঘুম হয়নি, রাত তিনটে অবধি জেগে থেকে কারেন্ট আসার অপেক্ষা করেছি। কিন্তু কারেন্ট না আসায় আর ঘুম হয়নি। কিন্তু ওই ছেলেটা এভাবেই ঘুমিয়েছে দিনের পর দিন, কেউ জানতেও চায় নি তার কষ্টের কথা। খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার নাক উঁচু তেমন ছিল না কিন্তু দুধ খাওয়া নিয়ে উদয়াস্ত এক চোট পর্ব চলত। আমিও খাব না, আর বাড়ির লোকেও ছাড়বে না। অর্ধেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে জানলা দিয়ে কত যে দুধ ফেলেছি তার হিসাব দিলে কয়েক হাজার টাকা হয়ে যাবে।বাবা মা বার বার জানতে চেয়েছে আমি দুধ খেয়েছি কিনা কিন্তু কেউ কখনো জানতে ছায়নি 'ওই' ছেলেটা কি খেয়েছে।


সময়টা ১৯৮৫। দক্ষিন ইউরোপে তখন এক প্রকার যুদ্ধের পরিস্থিতি। যুগোস্লোভিয়ার মধ্যে তখন জাতিদ্বন্দ্ব মধ্যগগনে। সবাইকে পর্যুদস্তু করে সার্বিয়া তখন আস্তে আস্তে দখল নিতে শুরু করেছে। ছেলেটা জন্মালো ক্রোয়েশিয়ার মডরিচিতে। কথায় কথায় দাঙ্গা, বোম পড়া এগুলো যেন নিত্য ঘটনা ছিল। যেখানে অন্য জায়গার ছেলেরা সকালে ঘুম থেকে উঠছে পাখির ডাকে সেখানে এর ঘুম ভাঙছে বোমের আওয়াজে। চারিদিকে এরম বাতাবরনে স্বপ্ন দেখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জের। বাড়িটা ছিল ভেলেবিট পাহাড়ের ঠিক কোলে; বাবা, মা, দাদু আর ছেলেটার সোনার সংসার। টালমাটালে সংসার চলছিল, কিন্তু বাধ সাজলো সার্বিয়ান আক্রমণকারী দল। ছেলেটির দাদু, লুকা সিনিওর প্রতিদিন গরুর পাল নিয়ে পাহাড়ে যেত চরাতে। সেটাই দেখে নেয় এই সার্বিয়ানরা। ক্ষমতার লোভে লকলক করতে থাকা সার্বিয়ানরা আটক করল দাদু কে। ছেলেটার চোখের সামনে এক সাথে সাত সিভিলিয়ানকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। এর মধ্যে লুকা সিনিয়রও ছিলেন। ক্রমাগত হানা দিতে লাগলো সার্বিয়ানরা তাদের বাড়িটায়। গোলাগুলি, বোমের আঘাত আর বারুদের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো তার বাস্তুবভিটের। দাদুর মৃত্যুর যন্ত্রনার সাথে বাস্তুভিটের আর্তনাদ সাথে নিয়েই ঘরছাড়া হল ছেলেটির পরিবার। তাকিয়ে দেখলো একবার, ছেলেটা জানে না আর কখনো ফিরতে পারবে কিনা।

পরিবার সমেত ছেলেটা এসে উঠলো জাদারের এক হোটেলে। এতটাও সামর্থ্য ছিল না যে হোটেলের জানলা দিয়ে শহরটাকে দেখবে। তাই ঠাঁই হল হোটেলের পার্কিং লটে। গোটা দেশ তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে ব্যতিব্যস্ত। দেশের ফুসফুস জুড়ে তখন বারুদের আস্তরণ। এরই মধ্যে বড় হচ্ছে সে। বাবা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সংসারে টানাটানি। কিন্তু এরই মধ্যে বাঁচার রসদ খুঁজছে সে। জাদারের আর পাঁচটা ছেলের মত তার কাছেও একটাই বাঁচার রসদ, ফুটবল। কোন প্রতিকূলতাই আর কোনভাবে বেঁধে রাখতে পারেনি তাকে। হাজার বোমের গন্ধের মাঝে, পার্কিং লটের অন্ধকারের মধ্যে, খানা খন্দের মধ্যেও ক্রমাগত চলেছে ফুটবল অধ্যয়ন। এক প্রকার পূণর্জন্ম হল তার, নামটা একই থাকলো, লুকা মড্রিচ।

কথায় আছে প্রতিভা কখনো চাপা থাকে না, শুধু অপেক্ষায় থাকে একজন পাকা জহুরীর। মড্রিচের এই অধ্যয়ন কোনভাবে চোখে পড়ে যায় জাগ্রেভের ওই হোটেলের এক কর্মচারীর। স্থানীয় ক্লাবে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখান থেকেই শুরু হল লুকার নতুন যাত্রা। স্থানীয় ক্লাবের অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষন নেওয়ার সময়েই তার শিল্প নৈপুণ্য চোখটানে বাকি দের। লোক মুখে কথাও শুরু হয়ে যায়। কপাল ফিরছে এই আশায় একটু মুখে হাসি আসার সাথে সাথেই আবার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অ্যাকাডেমি পাস করার পর লুকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার ছোটবেলার ক্লাব। সরাসরি না করে দেয় দলে নেওয়ার থেকে। কারন তার চেহারা। পায়ের কাজ অসামান্য হলেও খর্বকায় চেহারাটাই আসলে অন্তরায়। কোচ বলল এরম চেহারা নিয়ে ফুটবলে টেকা মুশকিল। আরো লম্বা চওড়া হলে তবেই জায়গা মিলবে। বছর পুরনো ক্লাবের থেকে এরম প্রতাখ্যান পেলে কারই বা ভালো লাগে। কিন্তু দৌড় তো থামানো যাবে না। উঠে পড়ে শুরু হল আবার চেষ্টা। অনেক ক্লাবের দরজায় দরজায় ঘুরেও ভাগ্যের চাকা ঘুরলো না; জুটলো কিছু পরিহাস। “আমি কি আদৌ পারবো?” এই সন্দেহের মেঘ যখন ঘনীভূত হচ্ছে মনের মধ্যে তখনই বৃষ্টি হয়ে দেখা দিল এক ইতালিয় দল। কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই একটা সুযোগ দেওয়া হল, দলে নেওয়া হল। হয়তো পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত এই সুযোগকেই পাখির চোখ করেছিল লুকা। যাত্রা শুরু হল।

  ইতালিতে কিছু অসাধারন পারফরম্যান্সের পর অবশেষে টমিস্লাভ বেসিচের তত্ত্বাবধানে ডায়নামো জাগ্রেভে ফিরে আসে মড্রিচ। ততদিনে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হয়ে গেছে, আবহাওয়া বেশ শান্ত। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কপাল ফিরলেও ফিরলো না মড্রিচের। ডায়নামো জাগ্রেভের যুব দলের হয়ে অসাধারন খেলার পরেও পরের মরসুমে বসনিয়া-হার্জেগোবিনার ক্লাব জ্রিন্সকি-মস্টারে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন ইউরোপে একটা কথা প্রচলিত ছিল, যে বসনিয়া- হারজেগোবিনার লিগে খেলে আসতে পারবে সে দুনিয়ার যে কোন জায়গায় খেলতে পারবে,এতটাই শারীরিক খেলা হয়। খাটো চেহারা, খর্বাকার খেলোয়াড় যে সেখানে দাপিয়ে বাড়াতে পারবে সেটা স্বপ্নেরও অতীত। নিন্দুকদের চুপ করিয়ে সেরা খেলোয়াড় হয়ে ফিরল লুকা। কিন্তু না, আবার তাকে পরীক্ষা দিতে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হল, ক্রোয়েশিয়ারই এক এক ছোট ক্লাব ইন্টার জাপ্রেসিচে। পুরনো কোন রেকর্ডই কথা বললো না লুকার হয়ে। চলে গেল সেকেন্ড ডিভিসন ক্লাবে। কিন্তু পাশা পালটে গেল একটা বছর পর। লুকা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল যে তারা ঠিক কতটা ভুল ছিল। তার ক্লাব শেষ করলো দুইয়ে। মড্রিচ লিগের সেরা প্লেয়ার হিসাবে নির্বাচিত হল। শুধু তাই না, ইন্টার জাপ্রেসিচ ইউএফা কাপের প্রথম রাউন্ডে খেলার সুযোগ পেল। ডায়নামো জাগ্রেভ বুঝলো এই রত্ন আর ফেলে রাখার না, সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল দশ বছরের চুক্তি আর একটা বড় অঙ্কের টাকা। স্বপ্ন সত্যি হল লুকার, পরিশ্রম মর্যাদা পেল। লুকার বয়স তখন কত আর হবে মেরে কেটে উনিশ কি কুড়ি। ওই বয়সে অত টাকা পেয়ে অনেকেরই মাথা ঘুরে যায়, লুকা কিন্তু অন্য রকম। ওই টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে বাবা মার হাতে তুলে দিল। লড়াই করে বেড়ে ওঠার ইতিহাস বোধহয় এভাবেই শেখায় মাটির কাছাকাছি থাকতে।

জাগ্রেভে বছর চারেক কাটানোর পর বড় লাফ দেওয়ার সময় এল। আবার সেই কষ্ট শুরু হল। বার্সেলোনা, আর্সেনাল, চেলসি মুখ ফিরিয়ে নিল, বলে দিল আমাদের খেলার সাথে খাপ খায় না লুকা। শেষমেশ হাত বাড়ালো টটেনহাম হটস্পার। গেরেথ বেলেও সাথে জুটি বানিয়ে একা হাতে পালটে দিল সব অঙ্ক। লিগ টেবিলের সাপ লুডো পেরিয়ে টটেনহাম জায়গা করে নিল প্রথম চারে। ব্যাপার গুলো যত সোজা আর যত তাড়াতাড়ি বলা গেল আদতে অত সহজে কিন্তু হয় নি। এর পিছনে সময় লাগলো প্রায় দু তিন বছর। প্রথম বছর তো সেভাবে খাপ খোলার সুযোগই পায়নি মড্রিচ। আর্সেন ওয়েঙ্গার থেকে শুরু করে ফুটবল পন্ডিতরা বলেই দিলেন যে শারীরিক সক্ষমতায় পেরে ওঠা সম্ভব না মড্রিচের। এসব কথা গুলোই হয়তো আরো এগিয়ে যেতে পাথেয় যুগিয়েছিল মড্রিচকে। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও তার ওপর অগাধ ভরসা ছিল হ্যারি রেডন্যপের, ততকালীন টটেনহ্যাম ম্যানেজার । তার ভরসাকে সাথে নিয়েই বহু যুদ্ধের নায়ক হয়ে বার বার ফিরে আসে মড্রিচ। চার বছর স্পারসে কাটানোর পর অবশেষে সুযোগ আসে তার ছোটবেলার স্বপ্নের ক্লাবে খেলার। ২০১২-১৩ মরসুমের জন্যে মড্রিচকে সই করায় রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু সেখানেও একই ব্যাপার, খেদিরা, জাভি আলোন্সো, ওজিল, এসিয়েন দের পিছনে বার বার পড়ে যেতে হত তাকে। কোন ম্যাচে হয়তো বদলি হিসাবে নামার সুযোগ পেত, কখনো বা পেত না। হাসাহাসি শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই নিয়ে, সবাই বলতে লাগলো এটা নাকি রিয়েল মাদ্রিদের সব থেকে খারাপ সই। দাঁতে দাঁত চেপে চললো প্রস্তুতি। চাকা ঘুরলো ২০১৩ তে মোরিনহো রিয়েল মাদ্রিদ ছাড়ার পর। আন্সেলোত্তি কোচ হয়ে আসার পর প্রথম দলে সুযোগ বাড়লো। আস্তে আস্তে মড্রিচ হয়ে উঠলো দলের নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ। এখন যারা আধুনিক ফুটবল দেখে তারা খুব ভালোভাবেই জানে মড্রিচ এখন দুনিয়ার প্রথম তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে একজন। আর তার যথেষ্ট কারন যে রয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তুমি বড় ফুটবলার, মহান ফুটবলার হতে পারো, কিন্তু সেই কথায় সিলমোহর তখনই পড়ে যখন তুমি বিশ্বকাপে নিজেকে মেলে ধরতে পারো। বছরের পর বছর ধরে নানা ভাবে পরীক্ষা নিতে থাকা জীবন বোধহয় সেই কথাই শিখিয়েছিল মড্রিচকে। চার চার বার মাদ্রিদকে ইউরোপ সেরা করার পরেও নিজের থেকে এখনো কিছু চাওার বাকি থেকে গেছে লুকার। আর তার মঞ্চই বিশ্বকাপ। ২০১৮ বিশকাপটাকেই যেন পাখির চোখ। শুরুতেই হোঁচট। গ্রুপ নির্বাচনে ভাগে পড়ল আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া আর আইসল্যান্ড। মেসি, ডিমারিয়া, আগুয়েরো, হিগুয়েন সমৃদ্ধ আর্জেন্টিনা যে কোন দিন এগিয়ে ক্রোয়েশিয়ার থেকে। নাইজেরিয়া আবার আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ান; তাই ছোট করে দেখবার কোন অবকাশই নেই। আর বাকি থাকলো আইসল্যান্ড। যাদের কাছে ফুটবল জীবনের মত, গুনগত নৈপুণ্যে পিছিয়ে থাকলেও ইচ্ছাশক্তির জোরে তারা ফুটবল বিশ্বে এক নবজাগরণ তৈরি করেছে। তাই ভয় থাকছে সেখানেও। কিন্তু যে দেশ বছরের পর বছর অবদলিত থাকার পরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নতুন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করতে পারে তাদের কাছে কি আর দুঃখ, কি আর কষ্ট, কি বা ভয়। সমস্ত অবহেলার জবাব দিতেই শুরু হল নতুন পরীক্ষা।

প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ২-০ গোলে পর্যুদস্ত করে গোটা দুনিয়াকে নিজেদের উপস্থিতি প্রমান দিল মড্রিচ, রাকিটিচ সমৃদ্ধ ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু সেই আনন্দে গোচনা পড়ে গেল এক ভয়ানক দুঃখজনক ব্যাপারে। ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপে এসেছিল মূলত দুজন স্ট্রাইকারের ভরসায়, মান্ডুকিচ্‌ আর কালিনিচ্‌। নাইজেরিয়া ম্যাচে মূলত মান্ডুকিচ কে সামনে রেখেই দল সাজান দলের কোচ। খেলায় সুবিধাজনক পরিস্থিতি দেখে রিজার্ভ বেঞ্চটা একটু দেখে নেওয়ার পরিকল্পনাতেই কালিনিচকে ওয়ার্ম-আপ করতে বলেন। কিন্তু কালিনিচ মানে না। তার মনে হয় এই দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় তিনি, আর এই মিনিট পাঁচ-সাতের জন্যে তিনি আর মাঠে নামবেন না। এই ক মিনিটের জন্যে মাঠে নামতে তার ইগোতে লাগছে। তখন বাধ্য হয়ে কোচ অন্য খেলোয়াড়কে মাঠে নামান। কিন্তু কালিনিচের এই রকম ইগোর সমস্যা দলকে পরে আরো ভোগাতে পারে ভেবে তার পরেরদিনেই রাশিয়া থেকে দেশে ফেরাতে বিমানে চাপতে হয় তাকে। সামনে আর্জেন্টিনা,আরো অনেক খেলা; তাই সব ক্যাপ্টেন মড্রিচ বুঝতে পারেন রাস্তা আরো কঠিন হয়ে গেল। আবার শুরু হল নতুন লড়াই। কালিনিচের ধারনা ছিল দল বুঝি বেশিদূর যেতে পারবেনা, তাই দলের বাকি দের ফোকাস নাড়ানোর জন্যে আর এক প্রকার হাসি ঠাট্টা করার জন্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের বেড়াতে যাওয়ার ছবি দিতে থাকেন। দলের ফোকাস যাতে না নড়ে তার জন্যে নতুন করে সবাইকে এক ছাতার তলায় আনলেন ক্যাপ্টেন মড্রিচ, পাশে পেলেন বহু পুরোন বন্ধু রাকিটিচ, মান্ডুকিচ, লভরেনের মতো সিনিয়র প্লেয়ার দের।

কেউ কস্মিন কালেও ভাবেনি আর্জেন্টিনাকে এভাবে মাটি ধরিয়ে মাঠ ছাড়বেন মড্রিচরা। ৩-০ তে এক প্রকার উড়িয়ে দিয়েই পরের রাউণ্ডে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করল তারা। কিছুটা হিসাবের বাইরে গিয়েই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ লিগে সবার উপরে ৯ পয়েন্ট নিয়ে শেষ করে তারা মুখোমুখি হল ডেনমার্কের। নির্ধারিত সময়ে ১-১ থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে ১১৯ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পায় ক্রোয়েশিয়া। বল মারতে এসে গোলকিপারের হাতে তুলে দেয় লুকা। সকল জাতির হাহাকারের মাঝে খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটে। সেখানে শট মারতে আসে মড্রিচ, কিন্তু এবারে কোন ভুল করেনি। গোলকিপার সুবাসিচের হাত ধরে দল যায় কোয়ার্টারে। জেতার থেকেঅ একটা বড় কথা হল মিনিট পাঁচেক আগে পেনাল্টি মিস করে দলকে খাদের কিনারায় পৌঁছে দেওয়া প্লেয়ারের মধ্যে নিজেকে তাগিদ করার কতটা চাহিদা না থাকলে কেউ সেই খাদের কিনারা থেকে দলকে বের করে আনার দায়িত্বটা নিতে এগিয়ে আসে।  ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হওয়া লুকা হয়তো বাঁচার রসদ এভাবেই খুঁজতে শিখেছে, যেখানে প্রতি মুহুর্তে বিপদ, প্রতিমুহুর্তে চ্যালেঞ্জ। ফেলে আসা দিনের ওই দাঁত চাপা অঙ্গীকারগুলোই কি এভাবে ইস্পাত কঠিন করে তুলেছে লুকা মড্রিচকে?

কোয়ার্টারে রাশিয়া আর সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ডের সাথেও ছবিটা সেই এক। ম্যাচ গড়িয়েছে ১২০ মিনিটে, অবশ্য ইংল্যান্ড ম্যাচে পেনাল্টি হয়নি। খেলার অতিরিক্ত সময়ে গোল করেই দলকে জিতিয়ে দেয় মান্ডুকিচ। ১৯৯৮ তে সেমিফাইনালে ওঠার পর থেকে এই প্রথম বার সেমিফাইনালে উঠলো ক্রোটরা। কিন্তু “ইটস কামিং হোম”-এর ব্ল্যাক ম্যাজিক এড়িয়ে প্রথমবার ফাইনালে উঠে সবাইকে  চুপ করিয়ে দিতে পেরেছে তারা। কিছু দিন আগে এক সাক্ষাতকারে রাকিটিচ বলেন যে প্রতিদিন বড় বড় দল গুলোর উপেক্ষা তাদের আগে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হয়তো সত্যিই তাই, অন্তত লুকা মড্রিচের জীবন সেই প্রমানই দেয়। ফাইনালে মড্রিচদের সামনে ফ্রান্স। মড্রিচরা জিতবে না হারবে, সোনার বল আদৌ সে পাবে কি না পাবে সেসব কথা সময় বলবে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ করে যাওয়া দেশ যে এতো সহজে মাথা নোওয়াবে না সে কথা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। খাতায় কলমে হয়তো অনেক এগিয়ে থাকবে ফ্রান্স, কিন্তু ওই অদম্য মনের জোর এক লহমায় সব ওলটপালট করে দিতে পারে। ফুটবল যে আসলে নিছক খেলা না, এটা জীবনের লড়াই। ১৯১১ তে মোহনবাগান যদি পারে, তাহলে ক্রোয়েশিয়াই বা পারবে না কেন? উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু এই স্বপ্নময় দৌড়ের কথা সারা বিশ্ব ঠিক বয়ে বেড়াবে বছরের পর বছর। আমি আজ এসির মধ্যে বসে হয়তো সেই ১৯৯১ এর গোলা গুলির আওয়াজ শুনতে পাবো না, বারুদের গন্ধে আমার ফুসফুসের দমবন্ধ হবে না, কিন্তু চাইব সেই প্রান গুলো শান্তি পাক, স্বীকৃতি পাক এই জয়ের মধ্যে দিয়ে। ইগোর কাছে হেরে যাওয়া কালিনিচও হয়তো নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে এই জয়টা চাইবে। হয়তো ফুটবল ইশ্বরও চাইবে উপেক্ষিত সেনাপতি মড্রিচ রাজার শিরোপা পাক। আমরাও হয়তো চাই আজ ক্রোয়েশিয়ার জয় দেখতে, কারন স্বাধীনতা অর্জনের কষ্ট আমাদের থেকে আর ভালো কেই বা বোঝে। হাজারটা ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের মধ্যে অন্তত একটা স্বপ্ন পূরণ হোক, এটুকুই চাওয়া...



পূরণ হোক “ইটস্‌ কামিং হোম” এই স্বপ্নটা...    








কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ – উইকিপিডিয়া





No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...