Saturday, 18 August 2018

স্বাধীনতা-দিবস





সপ্তাহের মাঝে ছুটি, এর থেকে ঈশ্বরিক সুখ আর কি হতে পারে। কলকাতাতে থেকে এক মাস বিরিয়ানি না খাওয়ার মত গর্হিত অপরাধের বোঝা বাড়াবো না বলেই টুক করে গুটি গুটি পায়ে অফিস থেকে ধাঁ, ঠিক সন্ধ্যেটা নামার পরে পরেই। বাস ধরে সোজা সায়েন্স সিটি, তার পরেই বাস বদলে পার্কসার্কাস; তার পর সেকেন্ড তিরিশ হেঁটেই রয়্যাল বিরিয়ানি। ঠিক মনে হচ্ছিল অপরাধের বোঝা ধুয়ে ফেলতে কোন মন্দির বা মসজিদে এসেছি।
গোনাগুন্তি পায়ের কদমে দোতলায় সোজা, হাতে মেনুকার্ড; একদম সেই চেনা ছক। এক নিঃশ্বাসে অর্ডার গুলো দিয়ে একটু হাত মুখ ধুতে গেলাম। পরের দিনটা পনেরো তারিখ, মানে পনেরোই আগস্ট, তাই আজ তো জমিয়ে খেতেই হবে। রয়্যালে আগে খেয়েছি বেশ কয়েকবার, কিন্তু এই নতুন দোকানটাতে আসা হয়নি। সব নতুন নতুন আধুনিকিকরণের মাঝেও কিন্তু সেই নবাবি মেজাজটা কিন্তু ধরে রেখেছে। ঠিক মিনিট পাঁচ সাত পর টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেল চিকেন মালাই কাবাব। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না  মিনিট দুই তিনের মধ্যে প্লেট ফাঁকা। তার পরেই দলে দলে এল মটন বিরিয়ানি চিকেন চাপ। বিরিয়ানি অর্ধেক শেষ হতে না হতেই চাপ ছাড়লো নিঃশ্বাস। চিকেন চাপের প্লেট ফাঁকা। আর একটা মটন চাপ অর্ডার করে দিলাম। মুখ ভর্তি বিরিয়ানি আর মটন চাপের চাকনা দিয়ে যখন আমার স্বপ্নের ঘোর চলছে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। একটু বিরক্তির সাথেই ফোনটা বের করে দেখলাম মামা ফোন করছে। মুখ ভর্তি বিরিয়ানি নিয়েই ফোনটা ধরলাম।
-       বলো…
-       বলছি শোননা, কাল তোর অফিস ছুটি তো?
-       হ্যাঁ, তো। কিন্তু কেন বলো তো?
-       বলছি শোন না, কাল তোর মাইমাকে নিয়ে একটু ময়দানে যাবি? কটা টেস্ট করানোর আছে।
-       ওহ, আচ্ছা। সে না হয় ঠিক আছে... কিন্তু...
-       যাক বাঁচালি। আরে দেখ না হঠাত করে আমায় একটা কাজ দিল্লি আসতে হয়েছে। এখন আমি এয়ারপোর্টে আছি। একটু পরেই ফ্লাইট। তুই তাহলে একটু দেখে দিস বাবা ওই দিকটা।
-       আচ্ছা ঠিক আছে। অফিসের কাজ নাকি?
-       হ্যাঁ রে। আচ্ছা শোন ফাইনাল কলিং চলছে। আমি পরে কথা বলছি বুঝলি। একটু মাইমাকে ফোন করে নিস।
-       আচ্ছা ঠিক আছে। হ্যাপি জার্নি। বাই।
-       হ্যাঁ রে, বাই। রাখলাম।

মামাতো ফোন রেখেই খালাস, এদিকে আমার হল মহাপাপ। কোথায় সপ্তাহের মধ্যে আরাম করে ল্যাদ খাবো ভেবেছিলাম, সেই প্ল্যানে জল ঢেলে দিল পুরো। ধুরররর্‌.......................................


মামিমাকে নিয়ে টেস্ট করাতে যাওয়ার পথেই আমার স্কুলটা পড়ে। টেস্ট করতে বেশ ঘন্টা দু তিন লাগবে, তাই মামিকে ওখানে রেখে একটু এদিক অদিক ঘুরতে ঘুরতে স্কুলের দিকটায় এলাম। দিনে দিনে কেমন যেন বদলে যাচ্ছে স্কুলটা। আগে প্রকান্ড ওই গেটের মাঝে একটা লম্বা সরু ফালির মত জায়গা ছিল, যেখান দিয়ে হাত গলিয়ে চলত স্বপ্নের লেনদেন। কম বয়সে স্টিকার কেনা, মাঝ বয়সে ঝালমুড়ি, চানাচুর, আচার; আর বড় বেলায় পাশের স্কুলের মেয়ে দেখা। সেসব এখন আর নেই। দেখলাম ওই দরজার পাশে কেমন বঞ্চিতের মত জাগা করে নিয়েছে একটা ছোট সরু গেট; অর্ধেক ভিজানো অবস্থায়। হাত দিয়ে ঠেলে ভেতরে একটু পা বাড়ানোর সাথে সাথেই কেমন একটা টাইম ট্রেল হয়ে গেল। পরের পর যেন সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। খানিকক্ষন পরে ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে এসে দেখলাম মাঠের এক পাশে টিম টিম করছে জাতীয় পতাকা। রাতভর বৃষ্টিতে ভেজা মাঠে মাঝে মাঝে জল জমে। কিন্তু কাদা ভরা নরম মাঠে কোথাও তো বুটের দাগ দেখলাম না। তাহলে ওরা কি আজ আসেনি? কেউই কি আজ আসেনি? ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে গেলাম।

।।

-       “ভাই তুমি আসতে পারো”
-       কিন্তু স্যার আমার তো আজ এখানে মাইক দেওয়ার কথা।
-       হ্যাঁ, কথা ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। তোমার মাইকের আমার দরকার নেই।
-       মানে? কেন স্যার? কি হল?
-       তোমার আসার কথা ছিল সাতটায়, এখন বাজে সাতটা বারো। অনুষ্ঠান শুরু হবে সাড়ে সাতটায়।
-       হ্যাঁ...হ্যাঁ... মানে স্যার একটু দেরি হয়ে গেছে।
-       আমি মনে করি যে মানুষের সময়ের কোন দাম নেই, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। যদি এই বাচ্ছা ছেলে গুলো স্কুলকে ভালবেসে সকাল সাড়ে সাতটায় আসতে পারে, তাহলে যার এটা রুজি রোজগার তার তো দশ মিনিট আগে এসে যাওয়ার কথা। তুমি এসো ভাই, আমার ছেলেরা খলি গলাতেই গান গাইবে।

সোজা হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন হেডস্যার। এমনি মুখে যে যাই কথা বলুক, সামনে ঠোঁট নাড়ার মত সাহস কারো ছিল না। সেদিন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায় শুরু হয়েছিল অনুষ্টান। সেদিন আর মাইক বাজেনি। খালি গলায় চিৎকার করে এক দাদা গেয়েছিল “অ্যায় মেরে ওয়াতানকে লোগো...” । ছোট ছোট ছেলেদের নিতে আসা বাবা মায়েরা করতালি দিয়ে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে গেছিল। সেই করতালিতে হয়ত আবেগের থেকে স্বস্তি ছিল বেশি, আশ্বাস ছিল যে হাতে ছেলে রয়েছে আর যাই হোক বেহাত হবে না।

স্কুল থেকে ফেরার পথে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

-       বাবা, বাবা...
-       হ্যাঁ বল।
-       আজ মাইক দিল না কেন?
-       মাইকওয়ালাকে তো ঢুকতে দেয় নি।
-       কেন?
-       আসতে দেরি করেছিল।
-       তো সে না হয় করেছিল, তা বলে মাইক ছাড়া এভাবে অনুষ্টান করা যায় নাকি?
-       হ্যাঁ, খুব যায়। আজই দেখলি তো।
-       এটা মনে হয় স্যার ঠিক করেনি। এভাবে করলে তো গল্য আরো লাগবে দাদাটার।
-       সে হয়ত লাগবে, কিন্তু আজ তো শিখিয়ে গেল সময়ের দাম কিভাবে দিতে হয়।
-       হুম।
-       আর যদি সকালে উঠে  দুধ খাবি না বলে বায়না করিস তোকেও এভাবে ঢুকতে দেবে না। এবার থেকে পাক্কা ছটা পঞ্চাশে গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
-       এটা কখন বললো?
-       কেন শুনলি না, স্যার মাঝখানে বললেন।
-       ওহ আচ্ছা। আজ তপন বাবু কে দেখলে? আমি তো দেখতে পেলাম না। একটা জিনিস জানতাম তাহলে।
-       না, আজ ওনাকে ঢুকতে দেননি স্যার। দেরি করেছিলেন বলে।
-       ওহ বাবা। এটা তো ভয়ানক ব্যাপার।
-       হুম, এবার সেই বুঝে।

।।

স্বাধীনতা দিবস মানে স্কুলের জামা পড়ে সবার আগে স্কুলে যাওয়া। আমাদের কাছে অন্তত এটুকুই ছিল। নিয়মমাফিক ওই দিনটায় স্কুলের মাঠে প্যারেড হত। আর প্রতি দলের মতই আমাদের স্কুলের প্যারেড দলেও একজন ফ্ল্যাগ বাহক ছিল। নিরন্তর লড়াই চলত এই পদের জন্যে, সবাই চাইতো এই জায়গায় নিজেকে দেখতে। বারো বছরের স্কুল জীবনে ২-৩ বছরের জন্যে ওই ফ্ল্যাগ বহনের গৌরব জড়িয়েছে আমার সাথে। সারা মাঠ ঘোরার পরে ফ্ল্যাগ নিয়ে জাতীয় পতাকার দিকে দাঁড়ানো এই অনুভূতি বলে বোঝানোর না। সেনার উর্দি পরার যোগ্যতা হয়ত হয়নি, আর কখনো হবেও না, কিন্তু ওইটুকু সময়ের জন্যে এই শিহরণটা কোন অংশে কম নয়। “অ্যাসেম্বলী, সাবধান…” এই আওয়াজের সাথে সাথে হেডস্যার উঠে আসতেন বেদির উপর। তারপর গায়ে জড়ানো দড়ি ধরে টান মারার সাথে সাথেই দলা পাকানো পতাকার ভাঁজের মধ্যে থেকে নেমে আসত এক ঝাঁক ফুল। তারপরেই আস্তে আস্তে সবাইকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে যেত পতাকা। মাঠে জমায়েত সব কালো মাথা গুলোর স্যালুটের মধ্যে দিয়েই শুরু হতো জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। সুর বেসুর সব মিলে মিশেই রোমকূপগুলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দিত, স্যালুট জানাত জাতীয় পতাকাকে। এর পরের ব্যাপার গুলো আর সেভাবে মনে রাখার মত না, কম বেশি একই রকম কথা গুলোকেই বার বার বলা হত বছরের পর বছর ধরে; সাথে সঙ্গত দিত সেই একই দেশাত্মবোধক গানের প্লে-লিস্ট। মনে রাখার মত ব্যাপার ছিল তারপরেরটা। লাইন দিয়ে টিফিন ঘরের কাছ থেকে খাবারের প্যাকেট নিতে হত। খাবারের রকমফের হয়তো বছর বছর হত না, কিন্তু এর মধ্যে কোনদিন একঘেঁয়েমি আসেনি। হয়তো দামি কিছু খাবার থাকতো না,কিন্তু ওই সাধারন খাবারটুকু খাওয়ার জন্যেই কত কত ছেলে আসতো। সব মেটার পর স্কুলের মাঠটা আবার একলা হয়ে যেত আর পাঁচটা ছুটির দিনের মত; শুধু বাকি রয়ে যেত লম্বা লম্বা দড়ির গায়ে আঠা দিয়ে আটকানো ছোট ছোট জাতীয় পতাকার প্রতীকি গুলো। পরের দিন যখন স্কুলে যেতাম তখন দেখতাম হেডস্যার দায়িত্ব নিয়ে ওই দড়িগুলো খোলাচ্ছেন, একটা একটা করে ধরে ধরে। তখন বুঝতাম না,কিন্তু পরে বুঝলাম এই তত্ত্বাবধানের কারন যাতে একটা জাতীয় পতাকাও মাটি না ছুঁতে পারে। আমরা কিন্তু যেতাম প্রতিটা বছর।


প্রায় ছয় বছর পর আবার পনেরোই আগস্ট স্কুলকে দেখে একটা টাইম ট্রেলের মত হল বটে। স্বাধীনতা দিবসের ফর্ম্যাট হয়তো এখন অনেক বদল এসেছে। স্মার্ট ফোন, ওয়াটস্যাপের যুগে মানুষ যখন ফোন তুলে শরীর খারাপের খবর নিতেও কুন্ঠাবোধ করে সেই পটভূমিকায় স্বাধীনতা দিবসের জন্যে স্কুলে আসার আশা করাটা নিছকই বাহুল্য বটে। এখন স্বাধীনতা দিবসতো সবার জন্যে ছুটিও হয় না, অনেকের স্বাধীনতা দিবস তো ৪ঠা জুলাই পালিত হয়। তাই সেক্ষেত্রে ফরওয়ার্ডেড মেসেজই ভরসা। কিন্তু আমি পাস করেছি আজ বছর সাতেক, এর মধ্যে এত বদলে যাবে সেটা হজম করাটাও কিন্তু একটু কষ্টেরই। আগে খাওয়ার লোভেই কত ছেলে আসতো, এখন হয়ত সেই খাওয়ার লোভটাই আর নেই; একটা সন্তানের যুগে হয়তো সমস্ত আবেগগুলোই এভাবে সস্তা হয়েছে, চাইলেই পাওয়া যায়। কেউ ছুটিও পেল, ঘুরতেও গেল; কিন্তু বাকি রয়ে গেল মাঠের কাদায় জুতোর দাগগুলো আর স্কুলের বেদিতে পতাকা রাখার জায়গাটা। নাহ কেউ সত্যিই আসেনি আজ, আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই।

          ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় কেটে গেল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় মিনিট ৩০-৪০ হয়ে গেছে গেটের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আর দাঁড়ালে দেরি হয়ে যাবে এই ভেবে আবার ফিরে গেলাম মাইমার কাছে। হয়তো কেউ জানলো না, কিন্তু ওই ফাঁকা মাঠ আর স্কুলের বাড়িগুলো জানে আমি এসেছিলাম, স্বাধীনতা দিবসের বার্তা নিয়ে।



No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...