Sunday, 24 June 2018

অন্য স্বপ্ন






মুখটা ঘুরিয়ে যেই না পিছনে দেখতে গেছি, একটা বড় বরফের বল এসে মুখে লাগলো পিছন ফিরে দেখি ঈশিতা মুচকি মুচকি হাসছে, বুঝেই গেলাম এই কম্মটি ওরই। আমিও আর বাদ যাবো কেন, আমিও একতাল বরফ তুলে গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়লাম। এভাবেই বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি, তার পর সাদা বরফে গড়াগড়ি; স্নো-ম্যান বানানো, তাকে চশমা পরিয়ে কত ছবি তুলছি। হঠাত ঈশিতা বললো, “তুমি কিছু বুঝতে পারলে?” আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললাম, “কই কিছু না তোকেন? কি হল?” ঈশিতা কেমন একটা ভয়ে পেয়ে বললো, “ না কিছু না।” আমরা দমলাম না, বরফ নিয়ে খেলেই যাচ্ছি; কলকাতার দাবদাহ থেকে মুক্তি কিছু দিনের। তারিয়ে তারিয়ে উপোভোগ করছি। একটা সেলফি তুলতে যাবো হঠাত করে দেখি পায়ের তলাটা কেমন কাঁপছে। অ্যাভালান্স আসছে ভেবে আমি আর ঈশিতা প্রায় প্রানপনে দৌড় শুরু করছি, হঠাত করেই একটা তীব্র আওয়াজ পেলাম, “ কিরে আর কতক্ষন ঘুমাবি, অফিস থেকে তো বের করে দেবে লেট করে গেলে...” ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দেখলাম মা ডাকছে, ওটা স্বপ্ন ছিল। মা বার বার ধাক্কা দিচ্ছিল বলে ওরম ভূমিকম্পের ফিল হচ্ছিল। ঘুম ভেঙ্গে এক লহমায় নেমে এলাম বরফের আচ্ছাদন থেকে কাঠফাটা রোদের মধ্যে। অফিস যেতে হবে, তাই আর বেশি ভাবা হয়নি। ধুর, মা আসল মজাটাই ঘেঁটে দিল।


বাসে যেতে যেতে জীবনের কিছু ঘন্টা রিয়াইন্ড করে দেখলাম। সেই স্বপ্ন, তাতে আমি আর ঈশিতা বরফ নিয়ে খেলছি। যদিও ঈশিতার থাকা বা বরফ কোনটা বেশি খুশীর সেটা বিচার না করেও এটা বুঝলাম যে বরফটা হয়তো অনেকটাই বেশি খুশীর, অন্তত এই দাবদাহের মধ্যে। যে বরফ আমাদের খুশীর কারন, সেই বরফ অন্য একজনের দুঃখের কারনও হতে পারে। ভিডিও দেখে খুব ভালো লাগে যে কত বরফ চারিদিকে, সাদা তে সাদা; বরফ পড়ছে, বরফ নিয়ে সবাই খেলছে এসব দেখতে ভালো লাগে; ভালো লাগে পাঁচ-দশ দিনের জন্যে। কিন্তু তার পর? আদৌ কি ভালো লাগবে তিন- চার মাসের জন্যে ওই এক ইঞ্চি বরফের কুশানে আটকে থাকতে? জানি না, মনে হয় না পারা যাবে বলে। কিন্তু ‘ওরা’ পারে, ‘ওদের’ পারতেই হয়, নাহলে যে অস্তিত্বটুকুও মুছে যাবে। আসুন আজ তাহলে একটা দেশের গল্প শোনাই।

দেশটা আইসল্যান্ড। ক্লাস এইটের ম্যাপ পয়েন্টিং ছাড়া বিশেষ আলাপ ছিল না দেশটার সাথে। ওই কিছু টুকটাক খবর, কিছু ছবি; ব্যাস ওইটুকুই, এর বাইরে আর আলাপ তেমন ছিল না। বাঙ্গালির কাছে আইসল্যান্ডের প্রথম আলাপ প্রসেনজিত চ্যাটার্জির “হনুমান ডট কম” এর সূত্রে। যদিও সেই আলাপ আসলে মুভি রিলের মাধ্যমে তাই সেটা কে বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো। প্রকৃত আলাপ জন্মায় ২০১৬তে, ইউরো কাপের আগে আগে। খুব হইচই পড়ে গেল ইউরো কাপে আইসল্যান্ড কোয়ালিফাই করার পর। ফুটবলপ্রেমি বাঙালি নেট খুলে উপর নিচে পড়ে নিল। প্রতিষ্ঠা পেল আইসল্যান্ড। চমকপ্রদ ভাবে পর্তুগাল আর হাঙ্গেরি কে আটকে দিয়ে র অস্ট্রিয়া কে ২-১ গোলে হারিয়ে পর্তুগালের উপরে শেষ করল তারা। উত্তীর্ন হল পরের রাউন্ডে। গোটা গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল; ভাইকিং ক্ল্যাপের গর্জনের সারা বিশ্বের কানে একটা বার্তা পৌছালো, ‘আমরা এসে গেছি’। শুরু হল এক নতুন রূপকথা।

এখন ‘গেম অফ থ্রোনস’ বলে টিভি সিরিজটার নাম শোনে নি এরম লোক লাখে একজন। তো সেই টিভি হয়েছে যাদের বলা হয় হোয়াইট ওয়াকার। সিরিজেই একদল লোক আদতে তারা বরফের দেশের মানুষ, যেখানে চির শৈত্য বিরাজ করে। আইসল্যান্ডিকদের ও সেই নামেই ডাকা হয় ফুটবল সার্কিটে। শুভ্র বর্ণ, দীর্ঘ তনু, বিশালাকার চেহারা সব মিলিয়েই এরম নামকরন। আর একটা কারন হল বরফ। আইসল্যান্ড বছরে ৩-৪ মাস পুরু বরফের নিচে থাকে। না হয় কোন ফসল, না হয় কিছু উৎপাদন।  কাজেই ভাঁড়ার দেখেই দিন চালাতে হয় তাদের। বরফ কমলে আস্তে আস্তে সেই জমি গুলো থেকে বরফ বের করে সেই মাটিকে চাষযোগ্য করে তুলতেই কেটে যায় আরো কিছু মাস। তার পর পড়ে থাকা বাকি মাস গুলোতেই চলে সারা বছরের অন্ন সংস্থানের চেষ্টা। ছেলেগুলো খেলবে কি, আগে তো মুখে কিছু তুলুক! চার-পাঁচ মাস বরফের তলায় থাকা মাঠের যে কি অবস্থা হতে পারে সেটা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা সবারই আছে। মাঠের ঘাসের মাঝের মাঝে বরফ জমে মাঠের তো দফা রফা। কিন্তু তাতে কি ফুটবলটা তো খেলতেই হবে। সমাজে মাৎস্যন্যায় নীতির মত এখানেও সেই ছবি। বয়সে বড় যারা তারা মাঠে খেলবে, আর ছোটরা এদিক সেদিক যেখানে পাওয়া যায় আর কি। মাঠ ছাড়া খেলার জায়গা বলতে কংক্রিট, কিন্তু সেখানে সমূহ বিপদ। পড়লে হাত পা কাটবে, একটা স্লাইডিং ট্যাকেলের জন্যে নিজের পা টাও ভেঙ্গে যেতেই পারে। কিন্তু সেসবে দমার পাত্র না, ফুটবলটা যে ওরা ভালোবাসে।

কথায় আছে প্র্যাকটিস মেকস অ্যা ম্যান পারফেক্ট। তুমি প্রভূত গুনের অধিকারী হতে পারো, কিন্তু অধ্যাবসায়ের কোন বিকল্প নেই। সেই কথাটাই যেন বার বার ফিরিয়ে দিয়ে যায় আইসল্যান্ডিকরা। হয়তো ওদের মেসি নেই, রোনাল্ডো নেই, নেই নেইমার; নাম নেই, যশ নেই; কিন্তু আছে ভালোবাসা, দেশের জন্যে জীবন দিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। ২০১৮ বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জন পর্বে তাই বাকি সবাই কে থামিয়ে দিয়ে সবার উপরে উঠে এল তারা। রাশিয়ায় প্রথম বিশ্বকাপের শরীক হওয়ার জন্যে হাজির হল প্রায় তিরিশ হাজার লোক। যে দেশের জনসংখ্যা কিনা কান মাথা টেনে সাড়ে তিন লাখ,তার মধ্যে তিরিশ হাজার এসেছে রাশিয়ায় খেলা দেখতে। এটা আবেগ ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে। গানের সুরে সুরে আছে না, ‘ তোমাদের ভালোবাসা মরনের পার থেকে ফিরায়ে নিয়েছে মোরে’; এখানে মরন হয়নি বটে, কিন্তু এই আবেগ থেকেই ফুটবলের নবজাগরন ঘটে গিয়েছে। মাঠে খেলার সময়েও দেশের প্রতি সেই আবেগটাই বার বার ধরা পড়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে বলের পিছনে যাওয়া, শেষ সময় অবধি হাল না ছাড়া এসব গুলোই বুঝিয়ে দেয় জেতার আর্তিটা। এদেরকে ভালোবাসতে কোন দলের জার্সি পরতে হয় না; আপনি ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল যা খুশি হতে পারেন, কিন্তু হয়তো মনে মনে এদের হেরে যাওয়াটা কখনো চান না। যে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এই তিন লাখের দেশটা সবার চোখে বিস্ময় জাগিয়েছে হয়তো সেই পথে গিয়ে আমাদের একশ তিন কোটির দেশটাও একদিন পারবে। ততদিন হয়তো কানে কানে বাজতে থাকুক এই ভাইকিং ক্ল্যাপের ছন্দটা... 






                     

                                          Farðí Íslandi … (গো আইসল্যান্ড … )





কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ- আইসল্যান্ড দলের খেলোয়াড় গানারসনকে। ওনার দেওয়া ইন্টারভিউ থেকে কিছু তথ্য সংগৃহিত।

No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...