Monday, 22 October 2018

শুভ বিজয়া



প্রায় এক মাস হতে চললো বাড়ি ছাড়া৷ সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে বসে আছি কোন এক নতুন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এই কদিনে অভ্যাস, স্বভাব, পরিবেশ, মানুষজন বেশ অনেক খানি বদলেছে। তাই পুরনোকে ধরে রেখে নতুনকে বরণ করার একটা নিরন্তর চেষ্টা চলেই যাচ্ছে লোকচোখের আড়ালে। অনেক কিছু মানাতে পারলেও একটা জিনিসকে মানাতে পারিনি, সেটা হলো দুর্গাপুজো।
বছর পঁচিশ বয়সে এসে এই প্রথমবার পুজো হাতছাড়া হওয়ার অনুভূতি প্রকাশের কোন ভাষা হয় না। বাঙালি আবেগপ্রবণ না তেমন, মনের থেকে মাথা দিয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু পুজো এলেই সব হিসেব কেমন পালটে যায়। তাই প্রথমবার তো; তাই হয়তো ওজনটা একটু বেশিই। যদি প্রশ্ন আসে এরম যে দেশের বাইরে এই প্রথম বার থেকে কি কি মিস করলাম বেশি; তাহলে হয়তো পরের পর বেশ কিছু পয়েন্ট দাঁড় করিয়ে দিতে পারবো। 


১. বন্ধুদের। এটা হয়তো এবারের পুজোতে সব থেকে বড় একটা না পাওয়ার জায়গা। সেই কোন ছোটবেলা থেকে ১৮-১৯ বছরের বন্ধুত্বের আঁচে আগুন পোহাই প্রতি পুজোতে; সেই আঁচটাই আর নেই। ওরা দেখা করেছে, হাসি মজা করেছে; বন্ধুত্বের বয়স আরো এক বছর বাড়িয়েছে সানন্দের সাথে; সেই জায়গাটাই হয়তো বাদ থেকে গেল এবার। ওরা ফোন করেছিল, ভিডিও কলও করেছিল। কিন্তু এক অন্যের সাথে যে ছোঁয়া সেটার তো আর প্রযুক্তিকরণ হয়নি। এটাই একটা বড় ক্ষেদের জায়গা।
 

২. পুজো পুজো আমেজ। পুজোর চারদিনের থেকেও এই আমেজের মাধুর্যটা আরো বেশি। কলকাতাতে থাকাকালীন দেখতাম
প্রায় মাসখানেক ধরে চলতো এই প্রস্তুতি। আগের বছর ঠাকুর জলে পড়ার পর পরেই শুরু হয়ে যেত পরের বারের জন্যে চিন্তাভাবনা। পুজোর দিন কাছে আসার সাথে সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কেনাকাটির ধুম। মানে মানে বিশ্বকর্মা পুজো পেরিয়ে যেতে না যেতেই দিন গোনার পালা। সাথে সাথে সারা শহর জুড়ে যেন একটা খুশির জোয়ার। ছোট বড়, ধনী গরিব সবাই যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় আস্তে আস্তে। পুজোর মাহাত্ম্যটাই এখানে, এই আসছে আসছে ব্যাপারটাকেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে হয়। এবারে সব পিছনে ফেলে আসার সময় দেখছিলাম আস্তে আস্তে সেজে উঠছিল রাস্তাঘাট, পরের পর প্যান্ডেল গুলোতে ধীরে ধীরে পড়ছিল শেষ তুলির টান; কুমারটুলি পাড়া তখন মহাযজ্ঞের আহুতি প্রস্তুতিতে উদ্যত। সব পাওয়ার দেশ থেকে হঠাত করে একটা না পাওয়ার দেশে এসে পড়লে শুন্যতাতো থেকেই যায়। ফেলে আসা পঁচিশ বছরের অভ্যাস কি এক ঝটকায় এক মাসে বদলে যেতে পারে!

৩। ঠাকুর দেখতে যাই না বহুবছর হল। মানে একটা আধটা ঠাকুর দেখিনা সেটা বলা ভীষন রকম ভাবেই মিথ্যে কথা বলা হবে, কিন্তু ওই আর কি লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে ঠাকুর দেখার পাঠ বহু বছর চুকেছে। তাই এই দিকটা নিয়ে খেদোক্তি সেরকম ছিল না এতো বছর ধরে। কিন্তু আসলে মানুষ তো দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না, তাই এতোদিনের জমানো খেদ ধরা দিল একাকীত্বে। যদিও ছবিতে ঠাকুর দেখার সব রকম বন্দোবস্তই ছিল সারা পুজো জুড়ে কিন্তু তবুও কোথাও নিউম্যারিকাল মেগাপিক্সেল একটু পিছনেই থেকে যায় চর্মচক্ষুর কাছে। হয়তো চোখের কাছে মুহূর্তবন্দী হয়না কিন্তু থেকে যায় মননে। এখানেই একটু যেন খামতি থেকে গেল বলে মনে হচ্ছে। তবে এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি সেই সব মানুষদের একান্ত ভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা এতো ভীড়ের মধ্যেও আমায় ঠাকুর দেখানোর মতো কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ পাঠালাম ডাকবাক্সে।

উপরের গুলোর আড়ালে যেটা আদতে বাকি থেকে গেল সেটা হল বিজয়ার প্রনাম। স্কুল কলেজের পাট চোকার পরেই এই বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রনাম করার ব্যাপারটা কমেই গেছে। কারন একাদশী থেকেই আবার অফিস, সেই রোজকার বিরক্তিকর রোজনামচা। তাই এতো কিছুর মাঝে আর সময় করে ওঠা হতো না, তাই ফোনেই বাকিটুকু আর কি। কিন্তু এর চক্করে ভালো ভালো মিস্টি কিন্তু হাতচাড়া হয়ে যেতে শুরু হল। পুজোর পরে পরেই নারকেলের সেই ছাপা মিস্টি, সাথে নাড়ু, নিমকি, কোথাও কোথাও আবার ঘুগনি, মিহিদানা, গজা, একটা নিয়মমাফিক রসগোল্লা কি পান্তুয়া মোটানুটি এসব দিয়েই থালা গুলো সাজতো। মাঝে মাঝে স্বাদ বদলে সোনপাপড়ি বা এক আধটা রসের মিস্টিও দেখা যেত। কিন্তু মধ্যাকথা হল খাওয়াটা। শুধুমাত্র এই কারন্টার জন্যেই হয়তো এতো গুলো বাড়িতে এতোদিন সময় নিয়ে প্রনাম করতে যেতাম। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরেও যেতাম কিন্তু পরিসরটা কমে এসেছিল আস্তে আস্তে। এবারে তো সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। তাই একজন আদ্যপান্ত, মোটা ভুঁড়িওয়ালা বাঙ্গালীর জন্যে নিশ্চিতভাবেই একটা দুঃখজনক ব্যাপার ছাড়া আর কোনভাবেই এটাকে ব্যখ্যা করা যায় না। কিন্তু কি আর করা যাবে যশ্মিন দেশে যদা চার।

বিজয়া নিয়ে এরম ভাবে আজে বাজে কাউকে কখনো লিখতে দেখেছেন? যদি হ্যাঁ বলেন তাহলে বুঝবো আমার মন রাখতে এসব বলছেন। বিজয়ার পরে মানুষ খাবে না এসব ভুলভাল পড়বে বলুন তো? আসলে আমি যেখানে থাকি সেখানে সারা বছরে দুশো দিন খালি প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি হয়, রোদ ওঠে না; একটা বাজে জায়গা। সেখানে বসে আমার সোনার কলকাতার বিজয়ার আবহ কি স্পর্শ করা সম্ভব কোনভাবে? তাই তো এসব লিখে একটু স্মৃতিচারণ করে দেখলাম যে ভিটামিন-ডির অভাবে আমার মননে আবার ময়লা জমলো কিনা। কিন্তু মনে হচ্ছে তো বেশ কাজ করেছে। খাতায় লিখে দিলুম এবার একটু মার্কসটাও দিয়ে দেবেন। শুরু যেভাবে করেছিলাম শেষটা একদম সেভাবে হবে না। শুভ,বিজয়ার সাথে প্রীতি আর শুভেচ্ছাকেও পাঠালাম আপনাদের কাছে,একটু সামলে রাখবেন; এখান থেকে গেল তো ওয়েদার বদলে একটু জ্বর সর্দি হতে পারে। সাথে করে টুপি দিয়ে দিয়েছি, এখন তো হিম পড়ার সময় তাই খেয়াল করবেন যেন মাথায় দেয়। বোঝেনই তো আজ কাল কার ছেলে মেয়ে, কথা শুনতে চায় না; কিন্তু কি আর করা যাবে। ভাবছেন অভিনন্দন গেল না কেন? আসলে ওর পরের মাসেই ইন্টারনাল পরীক্ষা আছে, এই কদিন একদম পড়েনি। তাই পাঠালাম না। আমার সাথেই থাকুক। সবার মনের যা যা ডিল ভগবানের কাছে ক্র্যাক করেছেন আশা করছি পরের বছরের মধ্যেই সেসব ফাইনালাইজ হয়ে যাবে। সবাই ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

                                 শুভ বিজয়া সবাই কে।।  





8 comments:

  1. Subho Bijaya. Tor charar samoyer good bye letter ta porechilam ekbar. Abar sujog holo subho Bijayar article porar.As usual ashadharon legeche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. নামটা unknown বলে দেখাচ্ছে, তাই বুঝতে পারছি না এটা আসলে কে। কিন্তু যে লেখনী এতো ভালো কথা বলে সেই মানুষ যে আরো ভালো হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নামটা লিখে দাও প্লিজ। 😊

      Delete
    2. Hahaahaha chinte parlina to?? Jayatu da.

      Delete
    3. আন্দাজটা ঠিকই করেছিলাম। 😊

      Delete
    4. Nana satyi khub bhalo laage tor lekha tai likhechi re.

      Delete
    5. Hyto pujoy dekha hoyna kono bar i thik kotha. Ager bar dekha korar plan kore koreo miss. Tobuo lekha ta pore vison valo laglo as usual. Tobe tor janya kharap o laglo 1tu. Jotoi khelai toke but afterall to bujhi j pujoy baire thakar kosto ta. Jak tobuo eisob ki6ur mdhye e anondo khuje neoa tai valo.. suvo bijoya sabu. Valo thakis. 🤓

      Delete
  2. শুভ বিজয়া। লেখাটা পড়ে মন তো ভরে গেলোই, উপরন্তু নিজের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল যে বছর গুলোয় পূজোয় বাড়ির বাইরে, দেশের বাইরে কাটিয়েছি। বড় ভাল হয়েছে লেখাটা। মন ছুঁয়ে যাওয়া। লেখনীর এই জোর এবং স্পর্শকাতরতা যেন বজায় থাকে এই কামনা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আশীর্বাদ করো যেন আরো ভালো লিখতে পারি৷ ��

      Delete

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...