ব্যাগপত্র গোছানো মোটামুটি শেষ। কাল বিকাল হলেই রওনা দেওয়া যাবে ছোট্ট হিয়ার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে। প্রায় অনেক বছর ধরে তার ইচ্ছা সে বেড়াতে যাবে। কিন্তু যাব,যাচ্ছি এই করে করেই আর হয়ে ওঠে না তন্ময়দার। সরকারি অফিসে কাজ নেই এই ধারণাটা যে ঠিক কতটা ভুল সেটা তন্ময়দাকে দেখলেই বোঝা যায়। নিত্তি ধরে ঠিক পৌনে নটায় বেরনো বাড়ি থেকে আর ফিরতে ফিরতে সেই রাত সাড়ে আটটা কি নটা; এর মধ্যেই জীবন শেষ।শেষ কবে পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন সেটা বোধহয় বৌদি ক্যালেণ্ডারে দাগ দিয়ে রেখেছে। অনেক বলে কয়ে এতো দিন পর একটা প্ল্যান হয়েছে। ট্রেনের টিকিট কেটে এনে বৌদির হাতে দেওয়ার পর বৌদির তো হার্টফেল হওয়ার যোগাড়। তা যাই হোক বাইরে যে যাওয়া হচ্ছে এটাই অনেক। মার্চ মাস, গরমটা কলকাতাতে একটু একটু জানান দিলেও দিল্লি আগ্রা যাওয়ার জন্যে বেশ বেশ ভালো মরসুম। তাই সব ভেবে চিন্তেই একদম দিল্লি আগ্রার প্ল্যানটা সেরে ফেলেছেন তন্ময় দা। শুক্রবার রাতের ট্রেন ধরে আগে আগ্রা, তার পর সেখান থেকে দিল্লি হয়ে অমৃতসরের লঙ্গর খেয়ে একদম প্লেন ধরে বাড়ি ফিরবে, মোটামুটি এরমই প্ল্যান। তাই দাঁড়ি পাল্লা মেপে সব পনেরো কেজির মধ্যে রেখেছে তন্ময় দা, যাতে সহজে চেক-ইনে পাচার করে দেওয়া যায়। যাওয়ার আগের দিন রাতে বাড়ির সবাই মিলে খেতে বসার আগে হিয়া তন্ময় দা কে জিজ্ঞাসা করলো,
- বাপি তুমি আগ্রা গেছ আগে?
- হ্যাঁ দেখেছি তো। তবে অনেক দিন হয়ে গেছে।
- আচ্ছা, তাহলে ওই অ্যালবামের লোকটা কি তুমি?
- হ্যাঁ, ওটা আমিই তো।
- ইসসস ছিঃ! কি বাজে দেখতে, মোটা কালো গোঁফ, লম্বা লম্বা চুল আর খ্যাংড়া কাঠির মতো চেহারার ওই লোকটা তুমি? ইসসস…
- হা হা হা… ওটা আমিই মা।
- না, আমার বাপিকে অনেক ভালো দেখতে। ওটা তুমি না।
বিয়ের আগে অর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে কাজ করা কালীন বেশ কয়েক বার তন্ময়দা গেছিল দিল্লিতে। সেখান থেকেই এক দুবার হয়তো তাজমহলেও গেছিল, তো সেই ছবি গুলোই রয়ে গেছে। হিয়া বোধহয় কবে না কবে একবার খুলে দেখেছে সেই থেকেই এসব কথা। হিয়ার ব্যাখ্যা একদম যে সঠিক সেটা কোনভাবেই বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজ কাজ করে করে তখন তন্ময়দার কি চেহারা, কিছুই মাথায় থাকে না, সংসারেও মন নেই। ছেলের এরম হাল দেখে জ্যেঠু জ্যেঠিমা একটা বউ আনলেন ঘরে, তাতে যদি ছেলের মতি ফেরে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কাজের নেশাটা ছাড়ানো গেল না বটে, তবে অপরুপা বউয়ের চক্করে সংসারে একটু মতি এলো। বৌদি ঘষে মেজে এখন তন্ময়দাকে একদম শুধরে দিয়েছে। আগের আর এখনের তন্ময়দার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত।
কিছুক্ষন পর হিয়া আবার জিজ্জাসা করলো,
- বাপি, তোমার কেমন লেগেছিল তাজমহল?
- সে অনেক বড় ঘটনা, এখন শুনতে গেলে তো রাত হয়ে যাবে। কাল সকালে উঠতে পারবে না আর স্কুলেও যাওয়া হবে না।
- না না না… হবে না। আমি এখনই শুনবো।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আগে খাওয়াটা শেষ করে নে তার পরে।
গল্প শোনার লোভে, বৌদিকে বিন্দুমাত্র না জ্বালিয়ে হিয়ার খাওয়া শেষ। বাকিরাও খাওয়া শেষ করার পরে সবাই মিলে চললো শোবার ঘরে।
শোবার আগে গল্প শোনা যে কোন বাচ্চারই নিত্য নৈমিত্তিক
দাবি, তাই হিয়াও সেই দাবি থেকে মুক্ত না। শোবার আগে যথারীতি তন্ময়দাকে গল্প
শোনাতেই হয়। এবারের টপিক তাজমহল। ঘরের বাকি আলো গুলো নিভিয়ে অল্প করে পাখাটা
চালিয়ে দিয়ে বিছানার পাশের ল্যাম্পটা জ্বেলে হিয়াকে কোলের কাছে নিয়ে বসল তন্ময়দা।
-
বাপি বাপি, তুমি কেন গেছিলে আগ্রা?
-
তখন তো আমি কলকাতার অফিসে কাজ
করতাম, ওদের কাজ ছিল এসব পুরনো বাড়ি,ঘর, বড় বড় মন্দির এসব নিয়ে দেখা শোনা করা। তো
এরম একটা কাজেই আমায় একবার দিল্লি যেতে হয়েছিল। তো সেখানেই...
-
বাপি দিল্লিতে কি অনেক মন্দির আছে?
বড় বড় বাড়ি আছে?
-
হ্যাঁ আছে তো। তাই জন্যেই তো
আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিল। বাড়ি, মন্দির এসব গুলো ঠিক আছে কিনা সেগুলো দেখার জন্যে।
তো আমরাও গেছি। এবার এক মাসের লম্বা কাজ ছিল, কিন্তু আমরা মোটামুটি দিন পঁচিশের
মধ্যেই কাজ শেষ করে ফেলার জন্যে হাতে প্রায় দিন তিন চার ছিল। তাই ওই কটা দিন আর কি
করবো, সামনেই আগ্রা; আর ইতিহাস বইতেই দেখেছি তাজমহলের ছবি। তাই আর লোভ সামলাতে
পারিনি, একদম ট্রেনের টিকিট কেটে হুশ করে চলে গেলাম আগ্রায়।
-
কিন্তু বাপি তুমি যে বল লোভ করা
পাপ...!! তাহলে তুমি যে লোভ সামলাতে না পেরে চলে গেলে? মানে তুমি তো পাপ করলে।
ইতিমধ্যে বৌদি, তন্ময়দাকে আকস্মিক একটা বাউন্সারের
মুখে পড়ে যেতে দেখে আর হাসি সামলাতে পারলে না। প্রানখোলা আওয়াজে হেসে উঠতেই হিয়া
মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টাল সামলে নিয়ে তন্ময়দা আবার
স্বমহিমায় বর্তমান।
-
না মা, এ লোভ সে লোভ না। এটা হল
জানার লোভ। এই যে ধর স্কুলে পড়াচ্ছে টু প্লাস টু মানে ফোর। এটা নিজে হাতে করে না
দেখলে ভালো লাগে?
-
না তো। না দেখলে কি ভাবে ভালো
লাগবে?
-
সেই জন্যেই তো। আমিও নতুন জিনিষ
জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই এই লোভটা থাকা ভালো।
-
আচ্ছা। তার পর কি দেখলে?
-
আগ্রা শহরটা বেশ সুন্দর একটা শহর,
এদিক অদিক গেলেই কিছু কিছু করে ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন সেই মোঘল যুগের কত
কত দুর্গ, কত অস্ত্রসস্ত্র, আরো অনেক অনেক সৌধ পাওয়া যায় এদিক সেদিক। কিন্তু এতো
কিছুর মধ্যেও শির জাগিয়ে বসে আছে সেই তাজমহল। বুঝলি, এই সৌধের এমনিই টান। দেশ
বিদেশ থেকে হাজার হাজার লোক ছুটে আসে দিনে দিনে শুধু তাজমহল দেখবে বলে।
-
আচ্ছা। তার পর?
-
আমাদের প্ল্যান ছিল ওই তাজমহলটাই
দেখা আর তার সাথে গোগ্রাসে বাকি জায়গাগুলোকেও ঢুঁ মারা যাতে দু দিনের মধ্যে ঘুরে
আবার ফিরে আসতে পারি দিল্লি। কিন্তু সে আর হল কই, রেস্ট নেওয়াও হল না, একবারে
হানটান করতে করতে দিল্লি পৌঁছালাম, তার ঘন্টা খানেক পরেই ট্রেন ধরে আবার বাড়ি।
-
কিন্তু তুমি যে বললে হাতে পাঁচ দিন
সময় ছিল, দুদিন ঘুরলে আর যাওয়া আসাতে আরো একদিন, তাহলে তো আরো দু দিন থেকে যায়
হাতে, তাহলে এরম ছোটাছুটি করলে কেন?
-
আমার তো তিন দিন কেটে গেল শুধু
তাজমহল দেখতেই। বাকি দিনে বাকি গুলো সামলাতে গিয়েই দেরি...
-
তাই...!!! এতো সুন্দর তাজমহল?
-
হ্যাঁ রে। একবার দেখলে আর চোখ
ফেরাতে পারবি না। শ্রীকৃষ্ণের পর হয়তো এই দুনিয়ার দ্বিতীয় কোন বস্তু যার জন্যে
মানুষ এরম ভাবে পাগল।
-
আমায় আরো কিছু গল্প বলো না বাপি।
আমি আরো শুনবো।
-
আচ্ছা ঠিক আছে, আজ আর না। বাকিটা
ট্রেনে যেতে যেতে বলবো।
-
না না না, আমি আজই শুনবো। তুমিই তো
বললে জানার লোভ সব সময় ভালো, ওই লোভে পাপ নেই। তাহলে আমি তো এখন জানতে চাইছি তুমি
বলছো না কেন?
-
ইয়ে মানে...
পাশে শুয়ে শুয়ে বৌদি আবার একটা মুচকি হাসি দিল। তন্ময়
দা নিজের জালে নিজেই জড়িয়েছে। হাসতে হাসতেই তন্ময়দার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসির রেশ
যেন আরো বেড়ে গেল।
-
ওহ বাপি, বল না, বল না।
-
হ্যাঁ যেটা বলছিলাম…
-
হুম বল। একদম শুরু থেকে বল।
-
দিল্লি থেকে আগ্রা ট্রেনে ওই ৪-৫ ঘন্টা মত লাগে। আমরা তো আগে থেকে সেরম ভাবে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি, আর অনলাইন টিকিট কাটাও ছিল না যে বুক করে নেব, তাই কাজ যেদিন শেষ হল সেদিনই দুপুর বেলা বেরিয়ে ওই দিন রাতের
টিকিট কাটলাম। এমনি জেনারেল কম্পার্টমেন্টের। জেনারেলে এমনি ভিড় হয় কিন্তু যেখানে কাজ করতাম সেখানেরই এক কলিগের
একজন চেনা জানা ছিল, তিনিই
কটা সিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। এমনিতেই তাজমহলের জন্যে আগ্রা মোটামুটি
বেশ জমজমাটি থাকে। তো আমরা ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ আগ্রা
ক্যান্টনমেন্ট স্টেশানে নামলাম। এটা মূল শহর থেকে একটু বাইরের দিকে, তাই শহরের মধ্যে আসতে গেলে একটা অটো চাই। তো বেশ খানিকক্ষন দেখার পর একটা অটো পাওয়া গেল, আর সেখান থেকেই সোজা চলে গেলাম আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসে।
আমাদের যাওয়ার সময়টা আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাই বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আমরা
পৌঁছালাম ওই ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে জানলাটা খুলেই...
-
তাজ দেখতে পেলে?
-
না না, তখনও কিন্তু আগ্রা বেশ ভালো
অন্ধকারে ডুবে আছে। আগ্রায় আসলে ভোর হয় আমাদের এখানের থেকে বেশ কয়েক ঘন্টা পরে। তো
সাড়ে চারটেতে এখানেও তেমন ভালো দেখা যায় না আর ওখানে তো বেশ ভালো রকম অন্ধকার। তার
ওপর ওরম কালো... সে আর দেখা যায় নাকি।
-
ওহ আচ্ছা। তারপর।
-
শীতকালে যেহেতু একটু দেরিতে সূর্য
ওঠে, তাই জন্যে তাজমহলের গেটও খোলে একটু দেরি করে। ওই ধর সাড়ে ছটা করে। তো আমি আর
সেই রাতে ঘুমাতে পারিনি, সোজা চলে গেছি সকাল সকাল গেট খোলার আগেই।
-
তারপর...
-
গিয়ে দেখি খুব একটা না হলেও ওই
ভোরবেলার অনুপাতে বেশ বড় লাইন রয়েছে, বেশিরভাগই বিদেশী। দেশী আর বিদেশীদের জন্যে
যথারীতি আলাদা লাইন, যেহেতু টিকিটের ভাড়াটা আলাদা, তাই। ঢোকার জায়গাটা একটু অদ্ভুত
রকম।
-
কেন কি রকম?
-
আসল যেটা তাজমহল সেখান দিয়ে ঢোকার
কোন রকম জায়গা নেই। ঢুকতে হয় অন্য একটা জায়গা দিয়ে। সেখান দিয়ে ঢোকার পর একটা ভীষন
সুন্দর বাগান পড়ে। তার মাঝে একটা সাদা শ্বেত পাথরের বেদি আছে, সেই বেদির পরোলে
একটা বিশাল উঁচু, প্রায় ধর এক তলা বাড়ির সমান একটা বিশাল বড় বেদি আছে। সেই বেদির
পরেই শুরু হয়ে যায় যমুনা নদী। ওই নদীর উপর দিয়ে একটা ঝুলন্ত ব্রীজ আছে। সেই ব্রীজ
পেরোলেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের তাজমহল।
-
আচ্ছা। তো বাবা নদীর ওপারেই তো এসব
কিছুর ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে তো এতোটা আর ঘুরতে হয় না।
-
হ্যাঁ সেটা ঠিক বলেছ, কিন্তু তাতে
একটা সমস্যা হত।
-
কি সমস্যা বাবা।
-
এই দেখো। ওই দিক দিয়ে যদি যাওয়া
আসার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে অনেক হোটেল হত ওই দিকে, ঠিক এই দিকে গেটের সামনেটায়
যেমন আছে। তাতে দিন রাত লোকের যাওয়া আসা, গাড়ি ঘোড়া, জ্যাম ঝঞ্ঝাট এসব থেকে আরো
পলিউশান হত, আর তাতে তাজমহলের অনেক ক্ষতি হত। এই সব পাথর গুলো এই ধুলো বালিতে খুব
নষ্ট হয়ে যায়।
-
আচ্ছা... কি বুদ্ধি বল বাবা...!!!
-
হা হা হা... তা ঠিক বলেছিস বটে।
গল্প বলা থামিয়ে দিয়ে হিয়াকে ঘুম পাড়ানোর একটা আপ্রান
চেষ্টা করলো তন্ময়দা। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হল না, আবার নতুন করে শুরু হয়ে গেল গল্প। কিছু বলতেও পারছে না, বলতে
গেলেই নিজের জালে জড়িয়ে দেবে তকে হিয়া।
- আচ্ছা আমায় তাজমহলের গল্প বল।
- সে বিশাল বড় গল্প, এভাবে
বলতে গেলে তো রাত ফুরিয়ে যাবে রে। কি করে বলি বলতো।
- না না, আমি জানি না। তোমায় বলতেই হবে।
- কিন্তু কাল যে স্কুল আছে। কি মুশকিল… কই গো তুমি একটু বল না কিছু।
ওদিকে বৌদিও হাত তুলে দিয়ে গোগ্রাসে গল্পগুলো গিলছে। তাই এখানে আর কিছু বলার জায়গাই নেই। বাধ্য হয়েই আবার ফিরে যেতে হল নিজের জায়গায়। শুরু হল গল্প বলা।
- ও বাপি, বল না।
- হুম বলছি দাঁড়া। একটু ভেবে নিতে দে। কোথা থেকে শুরু করবো।
- আচ্ছা।
- হুম শোন। সম্রাট আকবরের সময় থেকে মুঘল সাম্রাজ্য
আকার আয়তনে বাড়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক দিক থেকেও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। একের পর এক বিয়ের মাধ্যমে আকবর মোঘলদের পরম শত্রু রাজপুতদেরকেও
নিজের কাছে নিয়ে আসছিলেন আস্তে আস্তে। কিন্তু শুধু সাম্রাজ্য বাড়ালেই তো হয় না, বেড়ে যায় অনেক ভরণ পোষনের দায়িত্ব। সাথে সাথে খরচা পাতিও বেড়ে যায়। আর ঐশ্বর্যের দিক থেকে বিশেষ করে চোখে
পড়ার মতো হলেও রাজপুতদের থেকে তেমন রাজস্ব পাওয়া যেত না। তার ওপর আবার এই বার বার
রাজনৈতিক কারনে বিয়ের জন্যে প্রচুর খরচা, সব মিলিয়েই দিনে দিনে রাজকোষ আরো দুর্বল
হতে শুরু করে। আকবর মারা যাওয়ার পর সেই ব্যাটন সে পড়ে জাহাঙ্গীরের উপর। আর তার
পরেই আসে শাহজাহানের কাছে, আর সেই সময়েই...
- বাপি এই শাহজাহানই
তৈরি করেছিল না তাজমহল??
- হ্যাঁ, কিন্তু তুই কি
করে জানলি?
- মা কে জিজ্ঞাসা
করেছিলাম। মা বলেছিল।
- ওহ আচ্ছা।
- এর পর কি হলো বলো
না...
- একে রাজকোষের এই হাল,
তারপরে শাহজাহান হলো সৌন্দর্যের প্রেমিক। ব্যাস আর দেখে কি। তাই নিজের স্ত্রীকে
ভালোবাসার প্রমান হিসাবে জন্যে একটা স্মৃতিসৌধ বানানোর চিন্তা ভাবনাও করে ফেললেন।
এদিকে ভাঁড়ে মা ভবানী। কিন্তু কি আর করা যাবে, প্রেম একদিকে আর বাকি সব একদিকে।
তাই কিছু অল্প কিছু প্ল্যান করেই নেমে পড়লেন কাজে। রাজকোষের কথা ভেবেই প্ল্যান করা
হল যে যতটা কম খরচে পুরোটা মিটিয়ে ফেলা যায় ততই ভালো। সেই জন্যেই যমুনা নদীর ধারটা
বেছে নেওয়া হল।
- আচ্ছা, তার পর?
- যমুনা নদীতে তখন অতি
বৃষ্টির জন্যে প্রতি বছর বন্যা হত। তাই নদীর দু ধারের জায়গা গুলো কে বাঁচানোর
জন্যেই ওই জায়গাটাকে বাছা হয়। আর তা ছাড়াও প্রতি বছর বন্যেতেই প্রচুর খাবার নষ্ট
হতো, সেই জন্যে ওসব জায়গা থেকে রাজস্ব আদায় করা বেশ চাপের ব্যাপার হয়ে যেত। তাই ওই
জায়গাতেই তাজমহল বানানোর কথা ভাবা হয়। প্রথমটা ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ভাবা হয় সস্তায়
কিভাবে বানানো যাবে। এখন যেভাবে টেন্ডার ডাকা হয় তো সেভাবে
তখন দেশে বিদেশের নামি দামি সব আর্কিটেক্টদের ডাকা হলো। সব দিক বেয়ে চেয়ে শেষমেষ বেছে নেওয়া হয় মিমার শিনানকে। মিমার শিনান তখন মধ্য প্রাচ্যের একজন তরতাজা জোওয়ান ছেলে। চুলে পাক ধরেনি ঠিকই কিন্তু হাতের কাজে মোটামুটি সব দিক তাক লাগিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে
এক প্রকার। তাই তাকেই তলব করা হল এই বিশাল কাজের
জন্যে।
- আচ্ছা… কিন্তু এই লোকটাকেই কেন নিল?
- কি করে তোকে বোঝাই বল
তো, আসলে টেন্ডারের নিয়মটাই এরম, যে সব থেকে কম দামে ভালো জিনিস করে দিতে পারবে
তাকেই নেওয়া হয়।
- আচ্ছা, কি করে বুঝলো
যে ও ভাল করতে পারবে?
- এখানে আসার আগে ও যে
সমস্ত কাজগুলো করেছিলো সেগুলোই ওর পক্ষে কাজ করেছিল। এতো সব প্রশ্ন করিস না তো,
যেটা বলছি সেটা শোন।
- আচ্ছা বলো।
- তো নদীর ধারের বন্যা কবলিত জমিটাকেই ভালো ভাবে ব্যবহারের কথা ভেবে সেখানেই
তাজমহল বানানোর কথা ভাবা হয়। আর রাজকোষের কথা ভেবে ব্ল্যাকস্টোনের।
আসলে এই ব্ল্যাকস্টোন আমাদের দেশে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যেত আর প্রধানত রাজপুত অঞ্চল
থেকেই এগুলো পাওয়া যেত। তাই খরচার কথা ভেবে আর পুরোনো রাজস্বের কথা ভেবেই এই তাজমহল
বানানো হয়। প্রায় দীর্ঘ বারো বছরের চেষ্টায় শেষমেশ যখন তাজমহল বানানো হয় ততদিনে অনেক
কিছু বদলে গেছে। সেই তাজমহল দেখার জন্যে শাহজাহানও আর বেঁচে নেই, রয়ে গেছে তার স্ত্রী
মুমতাজ। স্ত্রীর জন্যে বানানো স্মৃতিসৌধ আর দেখা হলো না তার। ওই কালো তাজমহলের মধ্যেই
রাখা হয় শাহজাহানের মৃতদেহ।
- তার মানে ওর মধ্যে ভূত আছে…!!! আমি যাবো না।
- হা হা হা। হ্যাঁ সে থাকতেই পারে। সেটা তো না গেলে বুঝতে পারবি না। তাই ঘুরতে তো
যেতেই হবে। আর ওখানে তো আমি থাকবো। তাই তোর কোন ভয় নেই।
- আচ্ছা। তাহলে যাবো আমি।
- তারপর শোন না। শাহজাহান তো মারা গেল, কিন্তু শাহজাহানের মনে একটা ইচ্ছা ছিল যে
নদীর এপারে আর একটা তাজমহল বানানো হবে, তবে সেটা শ্বেতপাথরের, শুভ্র তাজ। আর দুই তাজের
মধ্যে একটা ব্রীজ থাকবে যেখান দিয়ে তারা পূর্নিমার রাতে একসাথে মিলবেন। কিন্তু শাহজাহান
তো আর নেই কিন্তু তার সেই ইচ্ছাপূরণের জন্যেই মুমতাজ শুরু করল ব্রীজ বানানোর কাজ।
ততদিনে সম্রাট হয়ে মসনদে বসেছে ঔরঙ্গজেব। রাজকোষের দৈন্য দশা দেখে তখনি ওই কাজ
বন্ধ করে দেওয়া হয়, মা মুমতাজকে বন্দী করে রাখা হয়। সেখান থেকেই বন্ধ হয়ে যায়
তাজের কাজ। আর আজ সেই কালো তাজই আমরা দেখতে পাই, সাদা তাজ আর দেখা হলো না রে,
বুঝলি...
- হুম, কিন্তু মা কে বন্দী করলো কেন? এটা তো ভুল, মা কে কেউ বন্ধী করে?
- না করে না তো, করা উচিতও না।
- তাহলে? ও যে করলো?
- হুম, সেদিন না করলে আজ হয়তো এই দিনটাই দেখতে পারতিস না। আবার শুভ্র তাজ বানাতে
দিয়ে হয়তো পথে বসতে হতো, সাথে সাথে হয়তো ইতিহাসেরও অনেক পালাবদল হয়ে যেত। আমরাও
হয়তো এভাবে থাকতে পারতাম না।
- হুম।
বেশ
অনেকক্ষণ ধরে গল্প শোনার পর হিয়া বেশ অনেক কিছুই বুঝলো বা বোঝার চেষ্টা করলো, তার
পর একটা বিশাল করে হাই তুলে হঠাত করে বলে বসলো,
- আচ্ছা বাবা ওখানে গরু আছে?
এটা
শুনে একটা প্রকান্ড চড়া হাসি হেসে তন্ময় দা বললো, “হ্যাঁ আছে। তাই বেশি দূরে দূরে
যাবি না, আমাদের সাথে সাথেই থাকবি। অনেক রাত হয়েছে, এখন শুয়ে পড়।” “হুম” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো হিয়া।
তন্ময়
দা আর বৌদি বুঝলো আগের মাসের সেই গরুর তাড়াটা এখনো ভুলতে পারেনি হিয়া।
[টিকা
টিপ্পনিঃ- ইতিহাস নিয়ে লেখা যদিও তবু একটু অন্যভাবে ইতিহাসটাকে নিয়ে দেখার চেষ্টা
করলাম। কিছু কিছু ঘটনাকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই বদলে দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, তাজমহল কিন্তু
আদতে শ্বেতপাথরের তৈরি, ধবধবে সাদা রঙের। কালো পাথরের তাজমহল বানানোর কথা হয়েছিল,
কিন্তু সেটা আর করা যায়নি। দ্বিতীয়ত, তাজমহল আসলে যমুনার দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে। উত্তর
পাড়ে কৃষ্ণতাজ হওয়ার কথা ছিল। তৃতীয়ত, তাজমহল বানানোর কাজটা সম্পন্ন করেন ইশা
আফেন্দি, যিনি আসলে মিমার শিনানের প্রিয়তম শিষ্য। মিমার শিনান অনেক বয়স্ক হওয়ার
জন্যে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ভারতে আসার নিমন্ত্রন পেলেও আসতে পারেননি। পরে
ইশা আফেন্দি আসেন, কিন্তু সেটা শাহজাহানের আমলে। চতুর্থত, তাজমহলে আসলে মুমতাজের
সমাধি রয়েছে, শাহজাহানের সমাধি যদিও রাখার কথা ছিল কৃষ্ণতাজে তবুও সেটা আর না
হওয়ার জন্যে ওই মুমতাজের পাশেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। পঞ্চমত, তাজমহলের আশে পাশে
কোন সেতু নেই, বানানো হত যদি কৃষ্ণতাজ তৈরি হতো। আর ঔরঙ্গজেব নিজের বাবা
শাহজাহানকে নজরবন্দী করেছিলেন, নিজের মা কে না।]
No comments:
Post a Comment