Thursday, 6 September 2018

শেষ রজনী




অদ্যই শেষ রজনী। কাল শুধু এসে একবার মুখ দেখিয়ে কার্ডটা জমা দিতে পারলেই ব্যাস শেষ। এরম একটা ভাব নিয়েই বিদায়ের মেলটা পাঠাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু না, আগে থেকে ভাবা আর সেই পরিস্থিতে অনুভব করার মধ্যে বেশ অনেকখানি তফাত আছে। এই কথাটাও হয়তো নতুন কিছু না, সবার জানা; কিন্তু পরিস্থিতিটাই আসল খেলা খেলে যায়। অ্যাড্রিনালিনের মিশ্রনে কোন সময় যে ট্রাইটেশান হয়ে কি রঙ নেবে কেউই জানে না।


যদি গাঁটে গুনে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে হয়তো বেশ কয়েকটা পয়েন্ট বলে দেওয়া যায়। প্রথমেই আসে বানতলা। জায়গাটা নিয়ে লোকের হাজার আপত্তি, আমারও আছে। না আছে ভালো খাবার, যোগাযোগ, ইচ্ছামতো বেরিয়ে আসার সুযোগ, ভালো পরিবেশ; তার ওপর চর্ম নগরীর জমানো চামড়ার এক অদ্ভুত গন্ধ। এতো না এর মধ্যে হ্যাঁ খোঁজার জায়গাটা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু একটা জায়গা আছে, সেটা হল একটা বেশ বড় মাঠ। অফিসে মাঠ! এতে খুশি খুঁজতে গেলে হয়তো চোখ কপালে উঠে যেতে পারে।কিন্তু ওই মাঠের জালে জালে প্রায় প্রতি বিকালে মুক্তি খুঁজতাম কিছুক্ষনের জন্যে। ভালো কি মন্দ সেসবের বিচার হয়তো করছি না, কিন্তু হাজারটা এক্সেল, গাদা গাদা সিনট্যাক্স, অনবরত ডেডলাইন, অনসাইট কল; এসবের থেকে একটু মুক্তি হয়তো এটাই ছিল।

পরের কথা আসি। খারাপ লাগার একটা কারন ছিল প্রতিদিনের ন-ঘন্টা। হ্যাঁ এটা সততই খারাপ লাগারই একটা জায়গা। সকাল দশটা থেকে এসে ঘাড় গুঁজে সাতটায় বেরিয়ে ট্রাফিকের হাঁড়িকাঠের মাথা রেখে বলি হয়ে ফেরার পর বিছানাটাকেই নিজের অন্তরাত্মা কাছে নিতে চায়। তাই অফিসের বাইরের সামাজিক জীবনটা বারে বারে ব্যহত হয়েছে। কিন্তু অন্যভাবে দেখতে গেলে অনেক টাকা অপচয়ের হাত থেকেও কিন্তু বেঁচেছি। সোজাসুজি না হলেও সেটা বারে বারে বুঝেছি।

প্রথমে কয়েকমাস ইউনিটেকে থাকার পর যখন বানতলায় এলাম তখন মনে হচ্ছিল কেন এই দ্বীপান্তর ভগবান। আর সেটা ভাবাটাই খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। নতুন নতুন কাউকে চিনতাম না। একটা ইন্টারভিউ দিতে এলাম, সারা দিন বসার পর বলা হল তুমি কাল থেকে এস এখানে। একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ওই রুটে একটা বাস চলে, তো সুবিধার কথা ভেবেই এই বাস নেওয়া। সেই শুরু। প্রথম দিন প্রোজেক্টে এসে আলাপ হল পিনাকি দার সাথে। আমার লিড দেবার্ঘ্য দা বললো এও নাকি আমার সাথেই এক বাসে যাওয়া আসা করে। বাঃ, তাহলে সঙ্গী পাওয়া গেল। বাসের যাওয়া এখান থেকেই শুরু। বেশ কয়েকদিন পরে আলাপ হল এক মহামানবের সাথে। একটা প্রথম সারির নাম করা বহুজাতিক কোম্পানির খুব উঁচু পোস্টে থাকা মানুষ যে এভাবে মিশতে পারেন আমার সাথে সেটা দেখেই আমি অবাক হয়ে গেলাম; ভুল ভাঙল। আমি আজ অবধি মনে করি হয়তো সেই দেখাটাই আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ন একটা অধ্যায়। এটা না হলে হয়তো বিরাট অংশ বাকি থেকে যেত। এই অতিমানবের নাম নেওয়ার প্রয়োজন হয়ত পড়বে না।

বাসে যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দু ঘন্টা। এই দুটো ঘন্টাতো আর মুখ বুজে, কানে ঠুলো গুঁজে বসে থাকা যায় না; তাই আস্তে আস্তে পরিশর বাড়লো, বন্ধু বান্ধব হল। মিশতে লাগলাম। তখন প্রথম প্রথম বাসের সামনের দিকে বসতাম, অতিমানবের পাশেই। আমার অনবরত ভুলভাল প্রশ্নের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলেও কখনো নিরাশ করেননি। যখন যেভাবে পেরেছেন আমায় জ্ঞান যুগিয়ে গেছেন। এই কথা গুলো হয়তো কৃতজ্ঞতা স্বীকার বলে মনে হবে, কিন্তু সেরম আদতেও না। এগুলো মনের কথা। পাখার হাওয়া খাবো বলে স্কুল কলেজে চিরকাল সামনে বসে এসেছি, তাই বাসে আর মন চাইলো না সামনে বসতে। আস্তে আস্তে পিছু হটলাম। সামনের সারি থেকে নেমে এলাম মাঝ দরিয়ায়। ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। অফিস বাসের পরিবর্তে আমাদের নিজেদের প্রাইভেট বাস এসেছে, আর পাকে চক্রে আমি তার তত্ত্বাবধানের অংশীদারও হয়েছি। “গ্র্যাভিটি অফ পরিস্থিতি” এখন অনেকটাই আলাদা।

মাঝ দরিয়ায় এসেও মন টেকানো গেল না। মাঝ দরিয়া ছেড়ে ফিরে গেলাম একদম লাস্ট বেঞ্চে। যতই যাই হোক এই লাস্ট বেঞ্চির মানুষগুলো কখনো কৌলিন্যপ্রথার ভাগীদার হতে পারলো না। গায়ে যেন ছোটলোকের তকমা লেগেই গিয়েছে আগে। কিন্তু কি আর করা যায়, হামেশা দিল কি শুনো। এখানে না এলে হয়তো আর্সালানে গিয়ে আলুপোস্ত খেয়ে ফিরে আসার মত অনুভূতি হত। এখানে কেউ কানে হেডফোন দেয় না, এখানে মানুষের সাথে মানুষ কথা বলে। এখানে লাউড স্পিকারে গান চালিয়ে আসে পাশের মানুষ গলা মেলায়। এখানে আনন্দটা শুধু একার না, বাকি সবার। কেউ হয়তো কাল রাতে খাসির মাংস খেয়েছে, কিন্তু এই অদ্ভুত ভালো বর্ণনায় হয়তো বাকি কয়েকজনেরও বাসি মাংসর ঝোল খাওয়া হয়ে যেত। এই জায়গায় মানুষ আধুনিক না হয়তো, কিন্তু আন্তরিক বটেই। আলাদা করে নাম বলতে চাই না, কারন এই লেখার যারা টার্গেট অডিয়েন্স তারা প্রত্যেকেই হয়তো এই লেখার মুখ গুলোকে চোখ বুজে চিনে নেবে। চেনা বাউনের পৈতে লাগে না।

এক হাঁড়ি ভর্তি রাবড়ি থেকে কখনো এক চামচ খেয়ে থাকা যায় না। একটা চামচের পর পরেরটার জন্যে মনটা খুঁজতে থাকে সেই চামচটাকে। স্মৃতিও এরকমই। একটু ভেবে রেখে দেওয়া যায় না, মনের মধ্যে সব সময়ই চলতে থাকে; হঠাত হঠাত কোন একটাকে আঁকড়ে ধরে আমরা হেসেনি বা কেঁদেনি। এখানেও ঠিক তাই। পরের সোমবার থেকে হয়তো শেষের রো-এর আগের টি-সিটারের জানলার ধারে অন্য কেউ বসবে, আরো অনেক ভালো ভালো গল্প হবে, দিলবার দিলবার গানটাও হয়তো জাতীয় সঙ্গীতের মত বাজবে; সেদিন হয়তো শোনার জন্যে আমি থাকবো না, কিন্তু ওই বারড়ির বাটির থেকে প্রথম চুমুক নেওয়া ভালোবাসাটাকে হয়তো কেউ কখনো সরাতে পারবে না। শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও আমি থেকে যাব মননে। অদ্যই শেষ রজনী, তাই হয়তো এই বলা কথা গুলোর ওজন একটু হলেও বেড়ে গেছে। পরশু থেকে অফিসের ওই ট্যাগটাকে হয়তো মিস করবো না, মিস করবো এই লোক গুলোকে, ওই লাস্ট বেঞ্চকে, ফেলে আসা মাঠটাকে, আর...       
         
হয়তো অনেক কিছুই,এখন মনে আসছে না..................



7 comments:

  1. এই লেখাটা অন্য লেখাদের থেকে অনেক আলাদা। শুধু বিষয়বস্তু নয়, ভাষাটাও অন্য মাত্রা এনেছে। সাব্বাস

    ReplyDelete
    Replies
    1. tomake dekhei to sekha. tomar moto kokhono likhte parle hoyto sedin ekta britto sompurno hobe.. :-)

      Delete
  2. Ektu holeo chokhe jol elo..jogajog rakhis..never want to loose u..

    ReplyDelete
  3. Khub e valo laglo Bhai lekha ta pore.. Best of luck

    ReplyDelete

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...