(প্রথম পর্বের পর...)
টুপ্…টুপ্…টুপ্…
বেশ অনেকক্ষন পরে সুজয় উঠলো। কি হলো জানবে বলে সে ফোনটাকে হাতে
তুলে নিলো। অরিন্দমের নাম্বারটায় ফোন করলো। কাল সারা রাত ফোনে পাওয়া যায়নি, আজ ও পাওয়া
যাচ্ছে না। উত্তেজনায়,উদ্বেগে এক প্রকার পাগল হয়ে যাওয়ার যোগাড় সুজয়ের। বহুক্ষন চেষ্টার
পর ফোনটা পাওয়া গেলো। রিং হচ্ছে। কিন্তু বেজে বেজে কেটে গেলো। ভারতীয় সময় তখন রাত দুটো-তিনটে
মতো হবে। অরিন্দম ঘুমাচ্ছে ভেবে সুজয় আর ফোন করলো না। মনটা কে মানিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা
করে যেতে লাগলো সুজয়। কিন্তু হাজার হোক মা তো। মন মানে না কিছুতেই। বিছানা ছেড়ে উঠে
সুজয় মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।
রোজকার কাজ
কর্ম সারছে সুজয়,তার মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো। আজ রবিবার। তাই সে সারা সপ্তাহের কাজ
গুছোছিল। কিন্তু মনটা তখনও ফোনের দিকে আটকে। তাই ফোন বাজতেই সেটা কান এড়িয়ে যায় নি।
প্রায় ওঁত পাতা শিকারির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা ধরলো সুজয়। ওটা অরিন্দমেরই ফোন।
-
কি রে,ফোন করেছিলি?
-
হ্যাঁ রে। কাল হঠাত করে ফোনটা কেটে গেলো আর তার পর সারারাত কিছুতেই
কানেক্ট করতে পারলাম না। খুব চিন্তা হচ্ছে রে। বল না, মা কেমন আছে? ডাক্তার দেখেছে?
কি বললো?
-
সেরম কিছু এখনও অবধি বলতে পারেনি। ৪৮ ঘন্টা সময় চেয়েছে। দেখি
কি বলে তার ভেতরে। আসলে বুঝতে পারছিস তো মাথার পিছনে লেগেছে। তাই চট করে কিছু বলা যাচ্ছে
না।
-
মাথার পেছনে? মানে? ঠিক কোন জায়গাটায় লেগেছে?
-
আরে মাথার পিছনের দিকটায়। মানে ওই ব্রম্ভতালুর থেকে একটু নিচে।
-
শিট্।
-
কি হল রে?
-
মা এর ওই জায়গাটায় আর একবার লেগেছিল। মা তার পর থেকেই একটু সাবধানে
চলতো। ইশশশ… আবার লাগলো ওই একই জায়গায়। এবার আমিও মা এর কাছে নেই। কি যে হবে মা এর।
বল না মা ভালো হয়ে যাবে তো? মা এর কিছু হবে না তো?
-
সু, সু, সু একটু শান্ত হ। এখন আমাদের শান্ত থাকতেই হবে। মাথা
ঠান্ডা না রাখতে পারলে আরও গোলমাল হয়ে যাবে। তুই একটু শান্ত হ।
-
কি করে বলছিস শান্ত হতে। একবার আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখ।
বুঝবি। শালা এতো দূরে পড়ে আছি আমি,সবাই কে ছেড়ে , না পারছি মা কে দেখতে, না পারছি মায়ের
কাছে যেতে। আমার ব্যাপারটা বুঝছিস অরি? একবার ভেবে দেখ… (কান্না)
-
সু, আমি সব বুঝতে পারছি রে। কিন্তু তুই যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়িস
তাহলে আমি কাকিমা কে কিভাবে সামলাই বল। আরে বেশি কিছু হয় নি। বেশি চিন্তা করিস না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি না? J
-
সত্যি বলছিস তো? মা এর কিছু হবে না তো?
-
হ্যাঁ রে বাবা… আমার ওপর এইটুকু ভরসা নেই। যা এখন চোখ মুখটা
ধুয়ে কিছু খেয়ে নে দেখি। আমি জানি কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয় নি তোর। আমি ও যাই এবার
হস্পিটালের দিকটায়। ভোর তো হয়েই এলো। আজ আবার কাকিমার রিপোর্ট আনার কথা।
-
রিপোর্ট…!! কিসের রিপোর্ট রে?
-
আরে কাল বলতে ভুলে গেছিলাম। কাকিমাকে ডাক্তার এম.আর.আই করতে
দিয়েছেন। তারই রিপোর্ট দেবে আজ। সেটা আনতে যেতে হবে। রিপর্টের ওপর ভিত্তি করেই তো আসল
চিকিতসা শুরু হবে। আমি রিপোর্ট এনে তোকে জানাবো। যদি এখন না জানাতে পারি তোকে পরে বেলার
দিকে আমি জানিয়েই দেবো।
-
আচ্চা রে। প্লিজ মা এর একটু খেয়াল রাখ। প্লিজ। আমি দেখি এদিকটায়
যদি কিছু ম্যানেজ করতে পারি।
-
আচ্ছা রে ঠিক আছে।
-
আর শোন, টাকা পয়সা কেমন কি খরচা হচ্ছে আমায় বল। আমি সম্ভব হলে
পাঠাচ্ছি।
-
থাক ওসব কথা। তুই ওখানে কিভাবে কষ্ট করে থাকিস সেটা কি আমি জানি
না? তুই বেশি না বোকে তোর দিকটা দেখ। আমি এদিকটা সামলে নেবো।
-
সত্যি রে অরি,তুই না থাকলে আজ কি হতো…
-
(কথা শেষ করতে না দিয়ে) ও এখন এসব বলবি তো? তাহলে আমি ফোনটা
রাখলাম। অনেক কাজ পড়ে আছে,সেগুলো করবো। তুই বাজে বোকা বন্ধ করে কাজ কর নিজের।আমি এখন
রাখলাম। বাই…
-
হ্যাঁ রে বাই…জানাবি মনে করে।
-
একদম রে। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফোনটা রেখে দিলো সুজয়। বন্ধুর কোথায় আশ্বস্ত হলেও মনের ভেতর
কিন্তু সেই খটকাটা কাজ করতেই থাকলো। মাথার পিছনে লেগেছে। সুজয় জানতো মাথার পিছনে লাগাটা
বিশেষ ভালো লক্ষন না। কারন ওখানে মা এর একটা চোট ছিল আগে। সেই অনেক বছর আগে। সুজয় কখনও
দেখেনি। কিন্তু শুনেছিল মা এর মুখ থেকেই। মাথার পিছনে চোট সুজয় কে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো
বহু বছর আগে।মনের মধ্যে ভেসে আসতে লাগলো বছর ২৪ আগের কিছু ভয়াবহ ঘটনা।
চার
গিরিশ
পার্ক, উত্তর কোলকাতা………… ২৪ বছর আগে
সময়টা ওই ১৯৯০-৯১ মতো হবে। কাকু কাকিমার বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন
হলো। গোকুলে তখন বেড়ে উঠছে সুজয়। কাকিমার তখন ৮ মাস মতো । নর্থ কোলকাতার ভাড়া বাড়িটায়
উঠেছে বেশ কিছু দিন হল। যে বা যারা নর্থ কোলকাতার বাড়ি গুলোতে গেছে তারা বুঝতে পারবে
যে ওগুলো ঠিক কতো টা ক্লস্ট্রোফোবিক। মানে ঘুপচি ঘুপচি ঘর, বাড়ি লাগোয়া দেওয়াল, এই
ছাদ থেকে ওই ছাদে চলে যাওয়ার সুবিধা, ছোট্ট এক ফালি উঠোন, চৌবাচ্চা এসব গুলোই নর্থ
কোলকাতার বাড়ি গুলোর পরিচয়বাহী। খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে বাইরে থেকে এসে হট করে মানিয়ে
নেওয়াটা ঠিক কতোটা কষ্টদায়ক। কিন্তু মানুষটা যখন সুজয়ের মা আর বাবা তখন এই কথা গুলো
খুবই বোকা বোকা বলে মনে হয়। মানিয়ে গুছিয়ে বেশ সুন্দর সংসার করছিলেন
ওনারা। কিন্তু সুখ বেশি দিন টেকে না। তো এমন এক গরমের দুপুরে সুজয়ের মা, রিঙ্কু
কাকিমা ছাদে উঠেছেন। কিছু জামাকাপড় শুকনো করতে দিতে। আর ওই জামার জল গুলো সিঁড়ি ময়
পড়েছিল। ব্যাস তাতেই আছাড় খেয়ে কাকিমা একদম সোজা গড়াতে গড়াতে নিচে। ব্যাস। সে তো এক
হুলস্থুল কান্ড। কাকুও বাড়িতে ছিলেন না। তার ওপর এই পোহাতি অবস্থায় এমন বিপত্তি। তখন
ফোনের প্রাদুর্ভাবও তেমন হয় নি। কাজেই খবরও দেওয়া যায় নি কাকু কে। শেষ মেষ পাড়ার লোকেরাই
ধরে করে ডাক্তার ডেকে আনে। তার পরামর্শেই কাকিমা কে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। সময় মতো
কাকুকে খবরও করা হয়। মানে সে কি বিপত্তি। একটা
সময় তো ডাক্তার জবাব দিয়েই বলেছিল যে বেবি কে আর বাঁচানো যাবে না। সেই তখন কাকিমার
মাথার পেছনে খুব বড় রকমের চোট হয়েছিলো। সেই চোটের দরুন কাকিমা বেশ সতর্কও থাকতেন ।
কেন এতোটা সতর্ক থাকতেন সেটা অবশ্য কখনও জানায় নি সুজয় কে। সুজয় এটা জানতে পেরেছিল
তার বাড়িওয়ালি জেঠিমার কাছে। সে তখন মা কে জিজ্ঞাসাও করে যে এই কথাটা কি সত্যি, কিন্তু
শিশু মন কে ভুলিয়ে কাকিমা কোনও ভাবে কথাটা
এড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই কথাটা আজ ও মনে আঁচড় কেটে রেখেছে সুজয়ের। আজ আবার যেন সেই পুরনো
স্মৃতিই চাগাড় দিয়ে উঠলো।
মাথার সেই চোট যে কতোটা গুরুত্বপুর্ণ ছিল সেটা পরবর্তী কালে
ভালোভাবে টের পাওয়া গেছিলো। ওই অংশটা আসলে কাকিমা চুল দিয়ে ঢেকে রাখতেন তাই তেমন বোঝা
যেত না। কিন্তু ওই চুলের নিচে শোয়ানো থাকতো কি ভয়াবহ চেহারা। আস্টে পৃষ্ঠে তেঁতুলে
বিছের মতো সেলাই চলেছে ওই কাটার ওপর দিয়ে। দেখলেই মনে হবে আসে পাশের চামড়া গুলোর মধ্যে
তীব্র বিবাদের জন্যে তারা আলাদা হতে চাইছে, আর একটা সম্প্রদায় কেমন যেন জোর করে দুই
পক্ষকে কাছে আনার চেষ্টা করছে। যখন পারছে না তাদের এক সাথে বাঁধার চেষ্টা করছে। এই
টানাটানির মাঝে ওই কলহের অন্তর্মহলে থাকা সব বেনো জলগুলো লালচে দাঁত বের করে হাসছে
হাঁ করে। সে কি ভয়াল দৃশ্য। সুজয় আস্তে আস্তে যখন বড় হল তখন বুঝতে শুরু করলো মা কেন
এলো চুল রাখতে পছন্দ করে না। খুব ভালো মনে পড়ে সুজয় ক্যামেরা নিয়ে খালি মা এর ছবি তুলতে
চাইতো। কিন্তু কাকিমা কখনও তুলতে দিতেন না। মাঝে মাঝে দিলেও চুল বেঁধে। একদিন সুজয়
বলেছিল,
-
মা,তুমি ওই নীল শাড়িটা পরো তো।
-
কেন রে?
-
আরে পরো না,পরতে বলছি যখন।
-
দাঁড়া বাপু। একটু তর দে আমায়।
-
আচ্ছা, তাড়াতাড়ি নাও।
কাকিমা সেজে শাড়ি পরে এলো। তার পর মা কে সাজতেও বললো সুজয়। কাকিমা
সাজার পর সুজয় ছবি তুলতে চাইলো।
-
হতচ্ছাড়া ছেলে,এই জন্যে আমায় সাজালি? \
-
হ্যাঁ। :-P
-
না আমি ছবি তুলবো না আর। আমার ছবি তুলতে হবে না আর।
-
আরে,এতো কষ্ট করে যখন সাজলেই তখন ছবিটা তুলেই নি না।
-
না তুলবি না বাবু। মার খাবি খুব।
কিন্তু কে আর কথা শোনে। কাকিমার ছবি তুলেই ছাড়ল। কিন্তু সুজয়ের এবার ইচ্ছা মা এর খোলা চুলে ছবি তুলবে।
কিন্তু কাকিমা রাজি হলেন না। সুজয় অনেক করে বললেন, কিন্তু কাকিমা কোনও ভাবেই রাজি হলেন
না। তাই সুজয়ের আর ওই এলোকেশি ছবি তোলা হলো না। কথায় কোনও ভাবে বুঝতে না দিলেও মাথার
ওই চোটের কারনেই কাকিমা এলোকেশি হতে চাইতেন না। কারনটা কখনও জানতে পারিনি আমরা কেউ,এমন
কি সুজয়ও না। তাই একটা আলটপকা আন্দাজ সবাই করতাম। হয়তো এলোকেশী হলে মাথার চুলের ঘনত্ব
কমে যায়,তাই মাথার শাঁস দেখা যায়। মাথার ভেতরের ওই রুপকথাটা সহজেই লোক চোখের মনীহার
হয়ে উঠবে সহজেই। তাই সব কিছু এড়াবার জন্যেই কাকিমা ওটা কে লুকতে চাইতেন ওই বিপুল একটা
খোঁপার আড়ালে। এটা আমাদের ধারনা ছিল,সুজয়েরও। এর পর কতো কথা লুকিয়ে রেখেছে ওই খোঁপার জাল।
এটা একটা
বেশ ছোট কথা। কাকিমা ওই মাথার সেলাই নিয়ে যে কতো ভুগেছিলেন তার কোনও হিসাব নেই। মাঝে মাঝেই কোনও ভাবে ওই জায়গায় হাত লাগলে কাকিমা
মাথা ঘুরে পড়ে যেতেন। কতক্ষন অচৈতন্য অবস্থায়, মুখ দিয়ে মাছি গলে যেত। সুজয় কিছু কিছু জানতো, কিছু আবার অজানাও রয়ে গেছে। ওই মাথার ব্যাথা যে সত্যি কতো ভোগাতো তার আঁচ কখন
লাগতে দেন নি সুজয়ের গায়ে। শুধু একবার মনে পড়ে , তখন সুজয় দের বাড়ির চিলেকোঠায় ওঠার জন্যে
একটা সিঁড়ি বানানো হলো। বহু বছর আগের সিঁড়িটা অকেজো হয়ে আছে। তাই সুজয় একটা নতুন করে
বানালো। সেই হাল আমলের ফ্যাশান ঘোরানো ঘোরানো সিঁড়ি। সিঁড়িটার একটা
খুব খারাপ ব্যাপার হলো বাইরের দিকে বের করা থাকে আর অনাবৃত। মানে ওই সিড়ির ধারের
খোঁচা খোঁচা অংশটা বাইরের দিকে থাকে। তাই একটু অসাবধানে চলা ফেরা করার সময় মাথায়
ওই কোনা টা লাগলেই আর দেখতে নেই,কেল্লা ফতে। এখানেও সেই একই ব্যাপারটা হলো।
কাকিমা ছাদে কিছু শুকনো করতে দিতে গেছিলেন। তো সেটা আনতে
গিয়ে যখন সিড়ির পাকদন্ডী বেয়ে নিচে নামছিলেন তখন একটা অল্প হাওয়া তে হাত থেকে একটা
জিনিস নিচে পড়ে যায়।আর এতেই যত বিপত্তি। সাধানরত সিড়ির নিচেটা একটু নোংরাই থাকে। ভালভাবে
পরিস্কার করা হয় না। তার উপর ছাদের সিঁড়ি হলে তো কথাই নেই।ঝড় জল
বৃষ্টি এসবের প্রাদুর্ভাবে সিড়ির তলাটা বেশ শ্যাওলা মতো হয়েই ছিল,তবে এটা শুকনো শ্যাওলা। কিন্তু
তাও ওই ধুলো যাতে না লাগে তাই কাকিমা ধড়মড় করে নিচে নেমে এসে তুললেন। দেখলেন
যে তেমন কিছু না লাগলেও কিছু জায়গায় ধুলো লেগেছে। ব্যাস,পরম
যত্নে ধুলো গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কাকিমা উঠতে গেলে বেশ বেখেয়ালেই মাথাটা ঠক করে লাগলো
ওই মুখ উঁচু করে বের করে থাকা সিড়ির কোনাটায়। একে রামে রক্ষে নেই,তার উপর সুগ্রীব
দোসর। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
(পরবর্তী পর্বের জন্যে চোখ রাখুন এই ব্লগের ওপর। যেহেতু এটি অসমাপ্ত লেখা, তাই কোনও রকম নামকরন করা সম্ভব হলো না। দুঃখিত।। )
No comments:
Post a Comment