#নো_স্পয়লার
ডিরেক্টরঃ- সুজিত সরকার
মুখ্য চরিত্রঃ- অমিতাভ বচ্চন, আয়ুষ্মান খুরানা
সময়ঃ- ২ ঘন্টা
ট্রেন থেকে নেমেই প্রথমে তুন্ডে কাবাবিতে গিয়ে মোটা মোটা দুটো পরোটা আর সাথে এক প্লেট গালাওটি কাবাব না খেলে আমার মন ভরে না। লক্ষ্ণৌ এসে গালাওটি কাবাব খাবো না এটা আবার সম্ভব নাকি! এক নিমেষে এসব খাওয়ার পরে একটা কাঁচের কাপে করে কড়া দুধ চা আর সাথে ময়দার বিস্কুট, এখান থেকেই শুরু। শেষ হবে ছাপান্ন ভোগের রকমারি মিষ্টি দিয়ে। লক্ষনৌ আর খাওয়া দাওয়া কোনভাবেই যেন আলাদা করা যায় না। সাথে মানুষের আতিথেওতা। গুটখা চেবানো লাল লাল দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে গালিব, ফৈয়জদের অবাধ যাতায়াত। এমনিতেই উর্দু মিষ্টি ভাষা সাথে আবার সেই খান্দানি আতিথেয়তা এলে এক কাঠি বেড়ে যায় কিনা। হালে টোটোর দৌরাত্ম্য কিছুটা বাড়লেও চৌওকে দাঁড়িয়ে থাকা টাঙ্গা গুলো জানিয়ে যায় নবাবিটা একটু ফিকে হয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি একেবারেই।
যে কারণে কথা গুলো বলা, সিনেমাটার প্রেক্ষাপট লক্ষ্ণৌ। আর একটু তলিয়ে দেখতে গেলে লক্ষ্ণৌ এর ফতিমা মহল। একটা ভাঙা চোরা মহল, নবাবি আমলের। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। সেখানেই থাকে এক দল ভাড়াটে। বহু বছর ধরেই যে এই বাড়িতে আছে সেটা বোঝাই যায় তাদের হাবেভাবে বা ব্যবহারে। এই দলের মাথা আয়ুষ্মান ওরফে বাঁকে আর অন্যদিকে বাড়ির মালিক অমিতাভ বচ্চন ওরফে মির্জা। এই বাঁকে আর মির্জার মধ্যে সংঘাত দিয়েই সিনেমা এগিয়েছে আর একদম শেষে একটা পরিণতিতে এসেছে।
যে বা যারা লক্ষ্ণৌ গেছে তারা জানে নবাবের পরিবার থেকে উত্তরাধিকারে পাওয়া এই মহল গুলোর এখন ঠিক কী অবস্থা। রক্ষণাবেক্ষণ করা হালের দিনে ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার আর খরচ সাপেক্ষ ও বটে। কিছ কিছু মহল সরকার নিজের আয়ত্তে নিলেও সরকারী ঢিলিমিশিতে সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। আর এই সব বাড়িতে ভাড়াটেরা এতই পুরোনো যে তাদের ভাড়া শুনলে হাসি পাবে। কেউ দেয় তিরিশ টাকা, কেউ দেয় পঞ্চাশ, আবার কেউ চল্লিশ। এই রীতিতেই তারা এতটাই অভ্যস্ত যে এই কমফোর্ট জোন থেকে বেরতে চায় না কেউ। সেটা স্বাভাবিক যদিও। মালিক বলে বলে বাড়াতে চেষ্টা করলেও বহু বছর থাকার সুবাদে ভাড়াটেদের ঔদ্ধত্যের শিখর আকাশ ছুঁয়েছে আর শিকড় অনেক গভীরে বেড়েছে। এই ঘটনা শুধু লক্ষ্ণৌতেই না আমাদের পশ্চিমবাংলার বহু জায়গায় দেখা যায়। মুর্শিদাবাদে তো দেখেছিই, এমন কী আমাদের উত্তর কলকাতাতেও অনেক জায়গায় দেখেছি। তো মালিক আর ভাড়াটেদের এই সঙ্গঘাতই সিনেমার মূল ইউএসপি।
এবার আসি অভিনয়ে। অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে নতুন করে কিছু আর বলার নেই। একজন ছ ফুট দু ইঞ্চি উচ্চতার মানুষ ওভাবে নিজেকে কুঁজো হয়ে যে অসাধারণ অভিনয়টা করে গেল সেটার জন্যে কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট না। চলন বলন, অভিব্যক্তি, স্বভাব সব দিক দিয়েই নিজেকে নিংড়ে একজন প্রকৃত ৭৮ বছরের বুড়োর ছবি তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। আর অন্যপিঠে আয়ুষ্মান। উত্তর ভারত সম্বন্ধীয় যে কোন সিনেমার পোস্টার বয় হিসাবে নিজেকে আবার জাস্টিফাই করেছে। অভিনয় যে অসাধারণ সে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। এছাড়াও ভিজয় রাজ আর বিজেন্দ্র কালা। একজন আর্কিওলজি ডিপার্ট্মেন্টের কেরাণি আর একজন উকিল যথাক্রমে। তাদের নিজ নিজ কাজের জন্যে যে সব কমিক টাইমিং তৈরি হয়েছে সেগুলো সিনেমার উতকর্ষতা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও আরো তিনটি চরিত্রের কথা বলতেই হয় ফারুক জাফর ওরফে বেগম, সৃষ্টি শ্রীবাস্তব ওরফে গুড্ডু বা আয়ুষ্মানের বোন আর নালনিস নীল ওরফে সেইখু। এই তিনজনের অভিনয় দেখার পরে কাস্টিং টিমের একটা পিঠ চাপড়ানি পাওনা থাকেই। ও হ্যাঁ আর একজনকে বাদ দিলে তো সিনেমার মজাটাই ফিকে হয়ে যায়। সে হলো আয়ুষ্মানের ছোট বোন। বেশি কথা নেই কিন্তু ইঞ্চ-পার্ফেক্ট কিছু ডায়লগ সিনেমার হিউমার কোশেন্টকে বাড়িয়েছে বই কমায় নি।
লক্ষ্ণৌ নিয়ে কথা হচ্ছে আর সঙ্গীত নিয়ে কথা হবে না এ কিভাবে সম্ভব! টপ্পা ঠুংরী গজলের আঁতুড় ঘর থেকে শান্তনু মৈত্র টেনে বের করলেন একটা অদ্ভুত কার্ড। সিনেমাতে গানের বিশেষ গুরুগম্ভীর ব্যবহার না থাকলেও আবহ সঙ্গীত মন কেড়ে নেয়। বিশেষ করে শেষের দিকে বৃষ্টির জলের সাথে পুরোনো স্মৃতি ধুয়ে যাওয়ার সময় গজলের করুণ সুর; মন কেড়ে নেই। পুরো সিনেমার আবহ সঙ্গীত ভালো লাগলেও ওই সিনটা আলাদা করে মন জিতে নেয়।
ডিরেক্টর সুজিত সরকারের স্টোরিটেলিং বরাবরই খুব ভালো। ইহান, ভিকি ডোনার থেকে শুরু করে অক্টোবর হয়ে এখন এখানে; একেবারে অক্ষত রয়েছে। কাজেই কাজ দেখলে বোঝা যাবেই যে এটাও খুব যত্ন নিয়ে বানানো। সিনেমার শুটিং লোকেশান থেকে শুরু করে আলোছায়ার সুন্দর ব্যবহারের মধ্যে সেই অরিজিনালিটি আর যত্নের ছাপ চোখে পড়ে। সিনেমাটা যেন বার বার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় “লোভে পাপ”। লোভ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে এই সিনেমটা সেটার একটা সুন্দর নিদর্শন রেখে যায়। লোভ যে পাপের সেটা আমরা সবাই জানি, তাই নতুন করে চমকে যাওয়ার কিছু নেই। আর সেই জায়গাটাকেই এক্সপ্লোর করে নতুন কিছু পরিবেশন করাটা আরো চ্যালেঞ্জিং। সেই দিক থেকে সুজিত সরকার বেশ বেশ ভালো ভাবে পুরো ব্যাপারটাকে গুছিয়েছেন। সিনেমার প্রথম দিকে চরিত্রায়ণের সময় একটু ধীর গতির লাগলেও সেটা পুষিয়ে যায় পরের অর্ধে। চরিত্রায়ণের জন্যে ওই টুকু সময় হয়ত দেওয়াই যায়। সিনেমার কিছু কিছু শট, যেমন চেয়ার টেনে নিয়ে যাওয়া, বা দরজার ফাঁক দিয়ে কনে দেখা আলো আর তার মধ্যে নিদেনপক্ষে বেলুন চুরি করে নিয়ে যাওয়া মির্জার মধ্যে হেরে যাওয়া এক বিদ্ধস্ত সেনার প্রতিশোধের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখা যায়। এখানেই পুরো হয় চরিত্রের আর্কটা। সব মিলিয়ে বলা চলে এই বছরের সব থেকে ভালো সিনেমা গুলাবো-সিতাবো। এক নিঃশ্বাসে দেখে নেওয়াটাই মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ। বড় পর্দায় দেখতে পেলে হয়ত আরো ভালো লাগত কিন্তু যা আছে তাই সই।
রেটিং খুব সাব্জেক্টিভ ব্যাপার তবুও বলি,
ডিরেকশানঃ- ৩.৫/৫
অভিনয়ঃ- ৪/৫
আবহ সংগীতঃ- ৩.৫/৫
পুরোপুরিঃ- ৩.৮/৫
- আপ কো ক্যা দিখা বেগম মে?
- মেহেল।
লোভ বড় খারাপ জিনিস, ছাড়তে না পারলে খুব মুশকিল। জলদি দেখে ফেলুন সিনেমাটা।
(ছবি সৌজন্যঃ- IMDB)
No comments:
Post a Comment