Thursday, 2 April 2020

হারানো বিকেল আর ঈশিতা





            ছোটবেলায় মা কে বলতাম বড় হয়ে ক্রিকেটার হব। গড়পড়তা বাকি ছেলেদের মতো শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভ বা সৌরভের স্টেপ আউট করে ছয় দেখে মুগ্ধ হয়ে না, বাইরে বাইরে খেলতে যায় এই কথা ভেবেই। সেই কোন ছোট থেকে বাইরে যাওয়ার সখ, কিন্তু দিনের শেষে অফিস থেকে ফেরার সময় উপলব্ধি হত যে এই স্বপ্ন বুঝি আর সত্যি হল না। মধ্যবিত্ত বাড়িতে বড় হওয়ার সময়েই বুঝে গেছিলাম ক্রিকেট আমার জন্যে শুধু টিভিতেই শোভা পায়, তাই সেই দিকে পা বাড়াই নি আর, কিন্তু বিদেশের লোভটা আর ছাড়তে পারিনি। হ্যাঁ, আমি এটাকে লোভ বলেই মানি, কারণ বিদেশে সব ভালো এই ধারণা আমাদের বদ্ধমূল আর সেটা থেকেই বেটার জিনিসের প্রতি ভালোবাসা বা লোভ জন্মানো। চাকরিতে ঢুকে বছর এক দুই থাকার পরেই বুঝে গেছি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার বিশেষ সুযোগ নেই। সেই দেখে আমি নিজে থেকেই শুরু করলাম। আমি সবসময় আগে অফিস এসে, আগে বেরিয়ে যাই অফিস থেকে, যাতে মৃতপ্রায় অবস্থায় বাড়ি আসার পরেও নিজের জন্যে কিছুটা সময় থাকে। কিন্তু নতুন এই কাজের জন্যে সেই সময়টুকু নিজের জন্যেই রেখে দেওয়া যায় না, সেখান থেকে আর অন্যকে কি দেব। ঈশিতা ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল। নিয়মবিরূদ্ধ ভাবেই সেদিন আমায় দুপুরে ফোন করেছে, তখন আমার লাঞ্চটাইম।





-       ব্যস্ত? ডিস্টার্ব করলাম?
-       না না, বল। হঠাত আজ? কিছু হয়েছে নাকি?
-       না এমনি। অনেকদিন কথা হয়নি, সো…
-       আরে আর বলিস না, আমি আসলে…
-       হ্যাঁ জানি, অফিসের কাজে ব্যস্ত।
-       না মানে শুধু সেটাই না, আরো একটা…
-       এই আবার কি হল, আর ইউ ওকে? সব ঠিক আছে তো?
-       আরে হ্যাঁ রে, সব ঠিক আছে। জাস্ট একটু…
-       এই প্লিজ বলো, কী হয়েছে?
-       সামনের শনিবার? ফ্রি?
-       কখন?
-       ওই বিকালে, পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটা করে?
-       ওকে ডান। বাট প্লিজ টেল মি। আই অ্যাম ওয়ারিড।
-       রিল্যাক্স, নাথিং টু ওয়ারি। আমি দেখা হলে বলব।
-       ওকে। বাট প্লিজ স্টে সেফ।
-       একদম। চাপ লেস। খেয়ে নি এবার?
-       সিওর। কি মেনু?
-       নাথিং মাচ। ওই যা হয়, রুটি আর তরকারি। ও না সাথে মিষ্টিও আছে।
-       হা হা হা,এঞ্জয়। স্টে সেফ।
-       ইউ টু।
-       হুম। আই মিস ইউ।

এই কথার উত্তর দেওয়ার আগেই ফোন কেটে দিল। বুঝলাম না এটা প্রত্যাশিত ছিল নাকি অন্য কিছু, তাই আমি সেকেন্ডখানেক সময় নিলাম হজম করতে। খাওয়া শেষে আমি যখন ডেস্কে ফিরছি তখন কেমন যেন মনটা খচখচ করছে। আমার কি উত্তর দেওয়া উচিত ছিল, নাকি যা করেছি ভাল করেছি-এর মধ্যে যুদ্ধ নিয়েই সিটে বসলাম। কিন্তু মিনিট খানেক পরে আর পারলাম না। ‘আই মিস ইউ’ লিখে মেসেজ পাঠিয়েই দিলাম। দেখি উত্তরে একটা হাসির স্মাইলি এসেছে দেখে মনে শান্তি নিয়ে কাজে বসলাম।

বইমেলার পরে এই প্রথম দেখা। প্রায় দিন পনেরো কি আরো বেশি হবে। এর মধ্যে বেশ অনেক কিছু হয়ে গেছে তাঁর কিছুই জানানো হয়নি কাউকেই; কাউকে মানে ঈশিতাকেও না। দেখা করতে যাওয়ার দিন তিনেক আগে যখন জার্মানি থেকে পড়তে যাওয়ার জন্যে কলেজের অ্যাকসেপ্টেন্স লেটারটা এলো তখন বিশাল খুশি হয়ে ভেবেছিলাম ওকে ফোন করে বলে দি। কিন্তু তারপরে ভাবলাম একেবারে দেখা হলে তারপরেই না হয় বলব। প্রতিবারের মতো আমি হাজির বিকাল পাঁচটায় এক্সাইড মোড়ে, আর উনি বরাবরের মতই লেট। মিনিট পনেরো অপেক্ষার পরে দেখি মেট্রোর গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে রয়্যাল ব্লু সালোয়ার পরে। ঈশিতা আর নীল এই কম্বিনেশানটা আমার যে কি ভীষণ পছন্দ সেটা বলে বোঝানো যাবে না। সে যাই হোক, আমায় দেখেই চোখে মুখে একটা হাসি; এই হাসিটার জন্যেই হয়তো বার বার প্রেমে পড়া যায়।

-       এই কেমন আছো? অল ওকে?
-       হুম রে, বলেছিলাম না চাপ নিস না।
-       আরে না না, চাপ না। মানে ইউ নো… বাদ দাও।
-       বুঝেছি আমি। মোমো খাবি?
-       উমম, মন্দ হয় না। রাতে কি বাইরে ডিনার?
-       হ্যাঁ অবশ্যই।
-       তাহলে এক প্লেট নাও।
-       ওকে।

এক্সাইডের মোড়ের মোমো মানে আমার আর ঈশিতার কাছে অমৃত। সেই কলেজ লাইফ থেকে এখানে মোমো খাচ্ছি একসাথে। খেতে খেতে কথায় জিজ্ঞেস করলো,

-       তোমার কি হয়েছে বললে তো না।
-       আরে বলছি রে, আগে খেয়ে নি।
-       প্লিজ বলো না, আই অ্যাম টেনশড।
-       আচ্ছা ওকে। বেসিকালি দুটো খবর আছে, একটা ভালো আর একটা খারাপ। কোনটা আগে শুনবি বল?
-       এই প্লিজ বলো না, কি খারাপ খবর?
-       খারাপ হলো আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
-       সে কি কেন? হঠাৎ কি হলো?
-       না মানে…
-       কি মানে মানে করছ, বলো না কি হলো?
-       আরে দাঁড়া দাঁড়া। ভালো খবর হলো আমি বাইরে যাচ্ছি।
-       মানে! কী সব বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ একটু খুলে বলবে?
-       হুম। আমি সামনের সেপ্টেম্বরে জার্মানি যাচ্ছি।
-       জার্মানি! ওয়াও, ব্যাপক তো। কি জন্যে।
-       মাস্টার্স।
-       ও মাই গড। এই খবরটা আগে দাও নি কেন আমায়?
-       না মানে আমি ভেবেছিলাম দেখা হলে তার পরে আর কী…
-       কি যে করো না! আই অ্যাম গোইং ম্যাড। কি দারুণ খবর দিলে তুমি…
-       হা হা হা। এতো লাফাস না, স্যুপটা বাইরে পড়বে।
-       সে পড়ুক। আমি বিশাল খুশি আজ। আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ। আজ কিন্তু ভালো জায়গায় যাবো টু সেলিব্রেট।
-       একদম চ তাহলে।

মোমো খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম পার্ক সার্কাসের দিকে। শহরের এই জায়গাটা বেশ চেনা আমাদের। কলেজের সময় থেকে বহুবার কারণে অকারণে হেঁটেছি এই পথ ধরে ঈশিতার সাথে। আর আমাদের খাওয়ার জন্যে সব থেকে পছন্দের জায়গাটাও ক্যামাক স্ট্রীটে। তাই সেই জায়গায় যাওয়ার জন্যেই হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঈশিতা জিজ্ঞেস করলো

-       কবে যাওয়া তাহলে?
-       এখনো ঠিক কিছুই নেই। গেলে ওই সেপ্টেম্বরের শেষের দিক করে।
-       গেলে মানে টা কী আবার?
-       না মানে এখনো অনেক কাজ আরকি বাকি আছে।
-       আচ্ছা। ও হয়ে যাবে। চাপ নেই।
-       না রে, চাপ আছে। ভিসা এই সেই অনেক কাজ এখনো।
-       সব হয়ে যাবে, চিন্তা করো না।
-       হুম
-       সো! আর তাহলে ছ মাস?
-       হুম। ওরকমই।
-       হুম

কথাটা বলার পরে যে উচ্ছ্বাসটা দেখেছিলাম ঈশিতার মধ্যে সেই উচ্ছ্বাস যেন সময়ের সাথে আস্তে আস্তে থিতিয়ে গেল। কথা তো ফুরোয়নি, কিন্তু কথা বলার জায়গাগুলো কেমন যেন নস্টালজিয়া নিয়ে নিয়েছে। এই খবরটা শুনে ঈশিতা যে খুশি হয়েছে সেটা প্রশ্নাতীত কিন্তু হয়তো এতো কিছু খুব কম সময়ে ঘটে যাওয়ার জন্যে সেগুলোকে ঠিক করে প্রসেস করতে পারেনি। আবার হয়তো আমার থেকে দূরে চলে যাওয়ার ভয়টাও কেমন যেন কুঁকড়ে দিয়েছে ওকে। এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে একটা কথা আমার মাথায় এলো, শেষ বারে বইমেলার থেকে ফেরার সময় ওর ব্যাগে “হায়রোগ্লিফের দেশে” বইটা দিয়েছিলাম আর দেখা করার কথা বলছিলাম ১৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু অফিসের কাজের চাপে আর দেখা করা হয়নি। কথা আগে এগোনোর জন্যে তাই জিজ্ঞাসা করলাম

-       হায়রোগ্লিফের দেশ বইটা পড়েছিলি?
-       হুম। তোমায় বললাম তো, সেটাও ভুলে গেছ?
-       বলেছিলি? হ্যাট না না। বলিস নি।
-       অমনি? বুঝেছি ভুলে গেছ। আর এখন মনে রাখবেই বা কেন!
-       আরে সত্যি বলেছিলি? কিভাবে ভুলে গেলাম রে!
-       আমি কি জানি, আজ কাল অনেক কিছুই ভুলে যাও। এমন কি ১৪ তারিখ দেখা…
-       এই এটা তো তোকে বলেছিলাম আমি, পরে একদিন দেখা করতেও চাইলাম কিন্তু তোর তো সময় হলো না, কি আর করবো।
-       হ্যাঁ জানি জানি। এই অফিস অফিস করেই তো এতো কিছু করে এখন আবার বলছ যে অফিস ছেড়ে দেবে। ছেড়েই যখন দেবে তখন এতো কাজ করার কি আছে?
-       এই তুই জানিস আমি কতো লয়্যাল! কাজের সময় নো ফাঁকি।
-       আরে আরে, এতো সিরিয়াস হয়ে গেলে কেন। আই নো হাউ আর ইউ, সো চিল।
-       হুম সেই।
-       এখনই যদি এত ভুলে যাও এর পরে কি হবে গো?
-       পরে মানে?
-       ইউ নো হোয়াট আই মিন!
-       এই না, বল।
-       উঁহু, সামাঝদারো কে লিয়ে ইশারা হি কাফি।

অদ্ভুত হেঁয়ালিতে আমায় ফেলে নাকানি চোবানি খাওয়ানো ঈশিতার সেই শখগুলোর মধ্যে অন্যতম সেটা তোদিনে বুঝে গেছি। তবে কথায় কথায় এতোক্ষনে বুঝে গেছি যে বরফ জমাতে এতো কসরত করছি সেই বরফ জমে গেছে এতোদিনে। এটাই যা শান্তির একটু।

এক্সাইড মোড় থেকে হেঁটে ক্যামাক স্ট্রীটের মোড় হেঁটে মিনিট দশ কি পনেরো। মোড় মাথায় ঢোকার মুখেই নিজাম প্যালেসের বিশাল গেটটা পড়ে। ওই গেটের বাইরে একটা ছোট চায়ের দোকান আছে, হয়তো চোখেও পড়বে না কারো। কিন্তু ওই দোকানটার সাথে একটা ভালো স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের দুজনেরই। একসাথে বেরিয়ে প্রথম চা খাওয়া এই দোকানেই, তাই এই চত্বরে এলে এই দোকান বাদ চলে যাবে এটা একদমই মেনে নেওয়া যায় না। তাই জিজ্ঞেস করলাম,

-       কি রে, চা খাবি?
-       ওই দোকানে?
-       হুম একদম, আবার না তো কি?
-       এটা আবার বলার মত প্রশ্ন হলো। অবশ্যই খাবো।
-       চ তাহলে।
-       হুম।

চা খেতে খেতে যখন অন্য বিষয়ে কথা বলতে মত আমরা তখন কথার ফাঁকেই হঠাৎ করে ঈশিতা বললো,

-       এই দোকানটাকে মিস করবে?
-       ওরে এখনো আমি যাই নি রে, অনেক বাকি। আদৌ যেতে পারি কি দেখি।
-       আবার সেই এক কথা। তুমি ঠিক যাবে, আমি জানি।
-       এখন বাদ দে না ওসব কথা। এখন তো এখানে আছি তোর সাথে।
-       হুম। বাদ দাও। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরে দিলে না।
-       হুম। দোকানটাকে মিস করবো কিনা জানি না, তবে চা খাওয়ার পার্টনারকে করব অবশ্যই।

মেঘলা আকাশে এরম ইয়র্কার বলের প্রতীক্ষা হয়তো ছিল না ঈশিতার। তাই অফ গার্ড অবস্থায় বোল্ড হয়ে যাওয়ার সম্ভবনাটাই বেশি। আর সেটাই হলো। একটু থমকে গিয়ে উত্তর দিল, “হুম”। মেয়েরা কেন যে মাঝে মাঝেই ভালোবাসা বা ভালোলাগার অনুভূতি গুলো লুকিয়ে যায় ভগবান জানে। হয়তো কিছুটা লজ্জায় বা নাকচ হওয়ার ভয়ে আবার হয়তো অন্যকে মেপে নেওয়ার অভিপ্রায়ে। কিন্তু ঈশিতার কি এখনো আমায় মাপার বাকি আছে কিছু? আমার তো মনে হয় না, কিন্তু তবুও যেন চেপে গেল আজ, আগের বার গুলোর মতই।

চা পর্বের পর রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের গলির মধ্যে ঢুকে মিনিট চার-পাঁচ হাটলেই আসে ক্যামাক স্ট্রীট প্যান্টালুন্স। জায়গাটার ঠিকানা আছে একটা বটে, সম্ভবত ২২ নম্বর ক্যামাক স্ট্রীট, কিন্তু ক্যাপিটালিজমের রমরমাতে সেসব মানুষ ভুলতে বসেছে। হাওড়া স্টেশানের ঘড়ি, সায়েন্স সিটির ডায়নোসরের মতো এটাও একটা ল্যান্ডমার্ক হয়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে। প্যান্টালুন্স যে কমপ্লেক্সে তারই একদম উপরের তলায় আমাদের দুজনেরই সব থেকে পছন্দের খাবার জায়গা “দ্যা ফ্যাক্টারি আউটলেট”। এখানে এসে কি খাবো সেটা মোটামুটি ঠিক করাই থাকে, যতবার এসেছি তার অন্যথা হয় নি। তো স্বাদ বদলাতে এবার ঈশিতা বললো

-       এবারে নতুন কিছু ট্রাই করি?
-       হ্যাঁ করা যেতেই পারে, আমার বিশেষ আপত্তি নেই।
-       আচ্ছা। তাহলে কি খাওয়াচ্ছ বলো।
-       তুই বল না, প্রতিবারের মতো এবারেও।
-       আরে প্রতিবারের সাথে এবারের ব্যাপারটা পুরো আলাদা। বুঝতে হবে বাবা!
-       কিছু আলাদা না, একদম আজে বাজে বকিস না তো। কি খাবি দেখে বলে দে তো।
-       আচ্ছা ঠিক আছে।
-       ডেসার্টটা কিন্তু আমার চয়েজ।
-       অ্যাজ অলওয়েজ।

বার বার এসে মেনুকার্ড দেখে মোটামুটি একটা আন্দাজ হয়েই গেছে যে কোন পাতায় কি খাবারের নাম লেখা আছে। তাই অর্ডার করতে বেশি সময় লাগে না। এবারেও তাই। এই দোকানের যেটা একটা ভালো ব্যাপার হলো খাবার অর্ডার করলে আসতে বেশি সময় নেয় না। আর আমাদের মতো দুজন বুভুক্ষু মানুষের কাছে এর থেকে ভালো ব্যাপার কি হতে পারে! খাওয়া দাওয়ার পরে শেষ পাতে ‘টি এফ ও বম্ব’ না খেলে কিছুতেই পুরো খাওয়া শেষ হয় না, আর সেটা নিছক কাকতালীয় ভাবেই আমার পছন্দই হয়ে দেখা দিয়েছে বার বার। এতো অবশ্য আপত্তি করেনি কখনো ঈশিতা। এতোটা ভালো বোঝাপড়া আমাদের।

ঈশিতাকে যেতে হবে বেশ অনেকটা দূরে, তাই খাওয়াদাওয়ার পরে যখন ঘড়ির সময় দেখলাম তখন প্রায় আটটা হতে চলেছে। কাছাকাছি মেট্রো স্টেশান বলতে ময়দান। তাই বেরিয়েই উল্টোদিকের হো চি মিন সরণী ধরে হাঁটা শুরু করলাম, মিনিট দশের পথ। কথায় কথায় কেমন যেন বার বার মনে হচ্ছিল এই শহর, এই পথ, এই উষ্ণতা আমার কাছে আবার একবার নতুন করে নতুন হয়ে যাবে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নি এখানে ২৫ বছর কাটিয়েছি তাহলেও কিন্তু কিছু নতুন আমার কাছে থেকেই যাবে। নতুন যে পরিবর্তন গুলো হবে সেগুলো আর দেখতে পারবো না আমি। মিনিট খানেক চুপ করে হাঁটার পর ঈশিতা বললো

-       মনে আছে যখন ব্যাঙ্গালোর গেছিলে?
-       থাকবে না আবার! ট্রেনিং সেরেই পালিয়ে এসেছিলাম। ভালো লাগত না বন্ধুদের ছেড়ে।
-       বন্ধু! শুধুই?
-       না মানে আরো অনেকে…
-       যেমন?
-       মা, বাবা, ভাই, আর… তুই।
-       হুম।

হেঁটে যখন মেট্রো স্টেশানে এলাম তখন প্রায় আটটা কুড়ি। ঈশিতার কাছে কার্ড আছে, তাই লাইনে দাঁড়াতে হয় নি। ট্রেনের জন্যে নীচে নেমে যাওয়ার আগে বললাম,

-       নীল সালোয়ার কেন পরিস?
-       ‘নীল রঙ ছিল ভীষণ প্রিয়’
-       তাই কি?
-       সেটা বোঝানোর দায় কর্তৃপক্ষের না।
-       সেই। কটায় ট্রেন?
-       এই হবে মিনিট খানেকের মধ্যে।
-       বাড়ি ফিরে জানাবি আমায়।
-       আজ অবধি কখনো মিস হয়েছে?
-       না, তবুও।
-       আজকেও হবে না। ঈশিতাকে এইটুকু ভরসা করা যায় আই থিংক।
-       সেটা আছে বলেই তো নিশ্চিন্ত।
-       আসি এবার।

এস্কেলেটার ধরে নীচে নেমে যেতে দেখে যেই মুখটা ঘুরিয়েছি অমনি দেখি একবার চেঁচিয়ে পিছুডাক, “তোমার ফেসটাইমটা চলে তো এখনো?”। হেসে সম্মতি জানাতে জানাতেই ঈশিতা নেমে গেল স্টেশানে। দেখা হবার শেষে প্রতিবারেই মন খারাপ হয় একটু, কিন্তু এবারে যেন একটু বেশিই মন খারাপ হলো। কুলফি তো জমেছে বটেই, কিন্তু সাথে ঠান্ডার শিরশিরানিটাও রেখে গেছে। হয়তো দেখা হবে কিছুদিন পরেই, কিন্তু ততক্ষণের জন্যে এই হা হুতাশটাই সাথে রাখি।

                                       আই উইল মিস হার…








No comments:

Post a Comment

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...