২৯শে জুলাই, ২০১৮। মাসের বাকি
গড়পড়তা বাকি রবিবার গুলোর মতোই আর একটা রবিবার। সকাল থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে
বৃষ্টির পূর্বাভাস করতে করতে বাজার যাওয়া,
তারপর
টুক করে রোদের দেখা পাওয়ার সাথে সাথেই বিগত এক সপ্তাহ ধরে শুকতে চাওয়ার বাসনা নিয়ে
ঝুলতে থাকা জামা কাপড় গুলোকে ছাদে মেলতে যাওয়া। মিনিট কয়েক পরেই আবার সেগুলো তুলতে
যাওয়া; তারপর ভাত মাংস খেয়ে দুপুরের
ঘুম, আর একটু হেলাফেলা করে জমানো
বিকালটুকু খরচা করে পরের দিন সকালে উঠে অফিসের বাস ধরার জন্যে নিজেকে সান্ত্বনা
দিতে দিতেই জাগার কোটা শেষ। হঠাত মনে হতে পারে হঠাত আজকের দিনটাকে নিয়েই পড়েছি কেন; কারন দিনটা ২৯শে জুলাই।
১৯০৫ সালে ভারতবর্ষের করুন অবস্থার কথা কার না জানা। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাতের
সাথে সাথে ইংরেজদের লাথির দাপট; জাতীয় কংগ্রেসের
ধারাবাহিক ব্যর্থতা, অন্যায় অত্যাচার সব
মিলিয়ে বাতাস কেমন বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। প্রতিটা সকাল যেন নতুন কোন ভয়াবহতার
প্রতীকি হয়ে উঠতো। সাথে লেগে রয়েছে আরো অনেক কিছু, সেসব কথা আমাদের ইতিহাস জানায়। ইতিহাস বইয়ের পাতায় খুব নিপুন ভাবে সেই অনুসঙ্গ
গুলো পাওয়া যায়। কিন্তু মন থেকে একবার ভেবে বলুন তো ইতিহাস কি আদৌ সব সত্যি কথা
বলে? মনে হয় না। হয়তো কথাগুলোকে
একটু ধৃষ্টতা মনে হবে কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে হয়তো ভালো বোঝা যাবে। মানে ধরুন
আপনি জানলেন শাহজাদা সুজা মারা গেছেন পাল্লা মাছ খেয়ে, যার অনুসঙ্গ ইতিহাস বই দেয়; কিন্তু সমসাময়িক আরো অনেক পরিস্থিতি চাপা পড়ে যায়। ইতিহাস হয়তো বড় জায়গাগুলোতে
আলোক পাত করে কিন্তু সমসাময়িক আরো কিছু ছোট ঘটনা কিন্তু পার পেয়ে যায়। হয়তো
পর্যাপ্ত তথ্যের অপুষ্টিতে। কলকাতা থেকে ১৯১১তে রাজধানী স্থানান্তরটাই হয়তো এভাবেই
ফিকে করে দিয়েছে সেই সালের ২৯শে জুলাই কে।
সেদিন আইএফে শিল্ডের ফাইনাল ছিল। একটা অত্যাচারিত, নিপীড়িত, পরাধীন দেশের কাছে
স্বাধীনতা লড়াইয়ের থেকে ফুটবল খেলাটাকে যে বিনোদন হিসাবে ভতর্সনা হিসাবে সেটা বলার
অপেক্ষা রাখে না। ইতিহাসও তাই মাফ করেনি। কিন্তু সবার কাছে লাঠিসোঁটা নিয়ে
মারামারি, কিংবা বোম ছোঁড়াটাই স্বাধীনতা
যুদ্ধ না এটাও মাথায় রাখতে হবে। উদাহরণ হিসাবে জাতীয় কংগ্রেসকে নিতেই পারি। তাদের
পথ ছিল আলাপ আলোচনা; সমঝোতা, এদের পথ হল ফুটবল। ১০ জুলাই থেকে যে সংগ্রাম একটু একটু করে
জন্ম নিয়েছে এই সংগ্রামকেই পরিনতি দেওয়ার শেষ সুযোগ। ইতিহাস মনে রাখুক কি না রাখুক
সেই প্রত্যাশার আশাতেই সেদিন নেমেছিল ওই এগারোজন ইস্ট ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে। বেশ
কয়েক বছর আগে এই খেলাটারই ইতিহাস নিয়ে একটা সিনেমা বেরিয়েছিল “এগারো” নামে।
সিনেমাটার শুটিং হয়েছিল বাড়ির কাছের একটা মাঠেই। মাঝে মাঝে দেখতেও গেছি। মাঠের এই
পরিবেশ কৃত্রিম ছিল বটে, কিন্তু অনুমান করতে
অসুবিধা হত না আসল সময়ে উত্তেজনা কেমন ছিল। যদিও বায়োস্কোপকে বিশ্বাস হয় না।
সিনেমায় একটা সংলাপেই ছিল, “এই খেলা শুধু খেলা নয়, সংগ্রাম।” খেলাটাকে একপ্রকার যুদ্ধ হিসাবেই নিয়েছিল ওরা, কারন “এখানে লাথি মারলে কেউ ফাটকে পুরবে না”।
১৯০৯ থেকে আইএফে শিল্ড খেলার সুযোগ পায়া মোহনবাগান। সাড়া জাগিয়ে শুরু করার
পরেও থমকে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। একই ঘটনা ১৯১০ সালেও। প্রায় সব না পাওয়ার জায়গা
থেকেই শুরু করতে হয় তাদের ১৯১১ তে। প্রথমেই মুখোমুখি হয় সেন্ট জেভিয়ার্সের।
ততকালীন ডিফেন্ডার সুধীর চ্যাটার্জী ভবানীপুর কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ইংরেজ
অধ্যুসিত সেই কলেজ তার ছুটি মঞ্জুর করেনি। তাই আর মাঠে আসা হয়নি সেদিন। কানু রায়ও
সেদিন মাঠে আসতে পারেনি। কানুর বদলি পাওয়া গেলেও সুধীরকে ভরানোর লোক মেলেনি। দল
খেলেছিল দশ জনেই। ওই দশ জনেই সেদিন ৩-০ গোলে পদানত করে শুরু হয়েছিল যাত্রা। দশ জনে
খেলে তিন গোল দেওয়াটা শুধু মাত্র একটা জয়ের সূচকই ছিল না, ছিল ইংরেজ ঔদ্ধত্যের ওপর একটা আঘাত। সাড়া জাগানো শুরুটা
কিন্তু নতুন ছিল না।, আগের দুবারই তাই
হয়েছিল। গাঁট ছিল দ্বিতীয় রাউন্ড। এবারে মুখোমুখি রেঞ্জার্স। ততকালীন সময়ে
রেঞ্জার্সের নাম ডাক বেশ ভালোই ছিল এবং ভয়াবহ দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য এটা যে একটা
খুব শক্ত গাঁট সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দলটা বুঝি অন্য ধাতুতে গড়া
ছিল। সেই নেমেসিসের কিনারা থেকে দলকে টেনে এনে নতুন দরজার সামনে দাঁড় করায় দলের
অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ী। একক দক্ষতায় দুই ডিফেন্ডারকে টপকে প্রথমে জালে বল জড়ায়, তার পর কানু রায়ের অসামান্য একটা দৌড় থেকে দ্বিতীয় গোলটা
করে যায়। সেদিন কাস্টমস মাঠের কাদা মাখা মাঠটাও আটকাতে পারেনি দলের সেই দুর্ভেদ্য
গতি। তৃতীয় রাউন্ডে সামনে আসে রাইফেল ব্রিগেড। সেদিন শুরুটা ভালো হয়নি; কাছে বন্ধুকে হারিয়ে বিজয়দাস ভাদুড়ী কেমন যেন খেলা থেকে
হারিয়ে যায়। কিন্তু অবশেষে সেই বিজয়ের পা থেকেই আসে জয়সূচক গোল। খেলার শেষ বাঁশি
বাজার পর স্কোরলাইন বলে ১-০।
এতোক্ষন সব ঠিকই ছিল, কিন্তু গন্ডগোল হল
সেমিফাইনালে এসে। মিডিলসেক্স রেজিমেন্টের সাথে যেন কোন ভাবেই এঁটে উঠতে পারছিল না
মোহনবাগান। মিডিলসেক্সের দুর্বার গতি ডালহৌসির মাঠ কাঁপিয়ে দিলেও টলাতে পারেনি হিরাদাসকে।
বার বার ধেয়ে আসা ঝড় ঝাপটা আটকে দিয়েছে ওই হিরাদাস। কিন্তু বাঁধ ভাঙল শেষে। মোহনবাগান পিছিয়ে গেল এক গোলে। ভয়, অনিশ্চয়তাকে সাথে নিয়েই কানু রায়ের এক অসামান্য দুরপাল্লার
শটের সাথে খেলা থেমে যায় ১-১ ফলাফলে। তখন পেনাল্টি শুট বা অতিরিক্ত সময়ের
ব্যাপারটা আসেনি, তাই খেলার ফলাফলের
আশায় নতুন ম্যাচ দেওয়া হল পরের দিন। কিন্তু রিপ্লেতে আরো ঝঞ্ঝাট। অত্যধিক বৃষ্টির
জন্যে সেই খোঁয়াড়ের মত মাঠে খেলা প্রায় এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে বাগানীদের।
কিন্তু কপাল ফিরলো অভিলাষ ঘোষের সহায়তায়। ‘ব্ল্যাক ডেভিল’ (অভিলাষ ঘোষের ময়দানী নাম)-এর
সাথে একটা সংঘাতে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয় মিডিলসেক্সের তথা গোটা টুর্নামেন্টের সেরা
গোলরক্ষক পিগট। ভাগ্যের চাকা সেখানেই ঘুরে যায়; শিবদাস ভাদুড়ী, হাবুল সরকার আর কানু
রায় ইতিহাসের আরো সামনে নিয়ে আসে দলকে। শেষ বাঁশি বাজার পর ফলাফল দাঁড়ায় ৩-০; মোহনবাগান চলে যায় ফাইনালে।
সেমিফাইনালের পর শুরু হয়ে যায় এক নোংরা খেলা। পিগটের চোখে লাগার জন্যে এক
প্রকার দোষী প্রমান করে দল থেকে বাইরে করে দলের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়াটাই হয়ে দাঁড়ায়
মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু শেষমেষ পিগটের বয়ানে ছাড়া পায় অভিলাষ। কিছুটা অপ্রত্যাশিত
ভাবে ফাইনালে উঠে আসার ঘটনাটাকে কোনভাবেই ভালো চোখে নেয়নি ইংরেজ দল। তাই জয়ের পথে যাতে কোন বাধা না থাকে সেই আয়োজনে
উঠে পড়ে লাগে তারা। এদিকে ইতিহাস দর্শনের জন্যে একপ্রকার মাঠে ঢল নামে মানুষের।
ক্যালকাটা ফুটবল গ্রাউন্ডে প্রায় সেদিন সত্তর আশি হাজার লোক আসে মোহনবাগানের হয়ে
গলা ফাটাতে। বাংলা ছাড়াও আসাম, ত্রিপুরা, বিহার থেকে আসে হাজার হাজার মানুষ। উদ্দেশ্য ছিল একটাই
ইংরেজদের বিপক্ষে গলা ফাটানো। প্রথমার্ধে এক গোলে পিছিয়ে পড়া মোহনবাগান প্রায়
খোঁচা খাওয়া বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বিতীয়ার্ধে। শিবদাস ভাদুড়ী গোলরক্ষককে চকিতে
কাটিয়ে নিয়ে ফাঁকা গোলে বল ঠেলে দলকে সমতায় ফেরায়। কিন্তু জয়সূচক গোল আসে সেই
অভিলাষ ঘোষের পা থেকেই। শিবদাস ভাদুড়ীর থেকে পাস নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে ফ্লিক করে
সেই বলেই একটা সোজা ভলি নেয় অভিলাষ। সেই বল গোলকিপারকে টপকে গেলেও ফিরে আসে পোস্টে
লেগে। ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নেয়নি কিন্তু,
সেই
ফিরতি বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বলকে জালে জড়িয়ে দেয় অভিলাষ। খেলা থামে ২-১ ফলাফলের সাথে।
এই অবধি ছিল ইতিহাস, যেটা হয়তো কোন বই
কখনো মর্যাদা দেবে না। কিন্তু এটা পড়েও কি কোনভাবে আন্দাজ করা যায় ইংরেজ দের কাঁটা
দেওয়া বুটের আঘাতে রক্ত ঝরতে থাকা পায়ের শটে কি পরিমান ঘৃণা লেগে থাকে? হয়তো না, আবার হয়তো হ্যাঁ; এর উত্তর নেই আমার কাছে। কিন্তু ইংরেজদের মনোবলে আঘাত
হানাটাও যে কোনভাবেই ছোট করা যায় না সেটাও মনে রাখতে হবে। আজ এই ঘটনাটা হয়তো শুধু
কিছু সমর্থকের মনে জায়গা করে নিয়েছে যারা এই দলটাকে ভালোবাসে। কিন্তু বাকিরা? তাদের কি অধিকার জন্মায় না এই কথাগুলো জানার। যখন এই ঘটনাটা
ঘটে তখন কিন্তু ফুটবলে রঙ লাগেনি, সবুজ মেরুনটাই তখন
ছিল গেরুয়া সাদা সবুজের প্রতীক। এই যুদ্ধ শুধু একটা ক্লাবের না, এটা সারা দেশের,
সমস্ত
ভারতীয়ের। জানিনা সময় আদৌ ভুলিয়ে দেবে কিনা এই ঘটনাকে, এই সংগ্রামকে, কিন্তু যতদিন মনে আছে
ততদিনই না হয় এই আমর একদশের মধ্যে দেশের মানুষ একটুকরো ‘চম্পানির’ খুঁজুক।
No comments:
Post a Comment