পরের দিন শনিবার, তার আগে একটু মদ না খেলে হয় নাকি!
অফিস ফেরত পাড়ার গলি থেকে ঠিক পাঁচটা গলির পরে প্রথম যে চার মাথার মোড়টা আসে, সেখান
থেকেই ডানদিকে মিনিট খানেক গেলে একটা বিলিতি মদের দোকান আছে। বেশি বড় না, চেনা জানার
মধ্যেই; এক ঝটকায় টুক করে গ্রিল গলিয়ে ৫০০ টাকার নোটটা ফেলেই কোনমতে ব্যাগে মাল চালান
করা অবধি একটু টেনশনের, তারপরে একদম স্মুথ। মেনুতে চিরাচরিত সেই ওল্ড মংক, বাদাম আর
কোল্ড ড্রিঙ্কস। প্রানে এতো ভয়, তবু মদ খাওয়া চাই। অন্তত শেষ ২ বছর ধরেই ফি হপ্তা এরকমই
চলছে অজয়ের। বাড়িতে বউ বহুবার বলেছে, কিন্তু সে শোনার পাত্র না। মাতলামি করে না বিশেষ
কিন্তু কি আর দরকার বাইরে যাওয়ার, তাই বাড়িতেই আসর সাজিয়ে…
দু তিন পাত্র পেটে যাওয়ার পরে কিছুটা স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই
গান বেরিয়ে আসে অজয়ের। ভয়ানক বেসুরোও নিজেকে তখন মহম্মদ রফি ভাবতেও একবার ভাবে না।
সেদিনেও ‘মেরে মেহেবুব কায়ামত হোগি…’ গাইতে গাইতে হঠাৎ গান থামিয়ে বলল,
-
ধুর শ্লা, কি সুন্দর গলা আমার, কিছুই
করতে পারলাম না জীবনে।
-
মদ খেয়ে নাটকটা না করলেই কি না?
-
নাটক! মনে হচ্ছে আমি নাটক করছি?
-
এসব প্রতি সপ্তাহের ন্যাকামি আমার দেখা
আছে। রাত হয়েছে শুতে দাও। নিজে গিলে গিলে মরো কি বাঁচো আমার দেখার দরকার নেই।
-
হোলি শিট…
-
আস্তে। অনেক রাত হয়েছে।
-
তা বলে শ্লা তুমি আমায় এসব বলবে?
-
গুড নাইট।
-
তুমি জানো না, তুমি কাকে অপমান করছো,
শালা নিজের ভালো বাড়ি থাকতে, শুধু তোমার কথা ভেবে এই ফ্ল্যাটটা নিলাম আমি তার পরেও
শালা এসব কথা। তুমি বুঝছো না, ধুর শ্লা।এভাবে নেশা হয় নাকি বাঁ…
-
জাহান্নামে যাও
-
শাট আপ। জাস্ট শাট আপ।
দেখে
নিও একদিন শালা বিশাল বাংলো কিনবো। পুল ফুল নিয়ে একদম শালা যা তা ব্যাপার। একটা লন
থাকবে আর আমার হাতে সিভাস রিগাল। শালা রানী করে রাখবো তোমায়, রানী।
নিত্য হপ্তাহান্তে এসব নাটক শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে
পারমিতার। দিনে রাতে স্বপ্নের কেনা বেচা ওই মদের গ্লাসেই জন্মায় আর সেখানেই শুকিয়ে
যায়; লৌকিক জীবনে আর স্পর্শ করে না পারমিতাকে। বিয়ের ৪ বছর পরে তাই পুরনো ভালোবাসার
মানে খোঁজটাও কেমন একটা দমবন্ধকর অবস্থার তৈরি করে তার কাছে। ইচ্ছা ছিলো ৪-৫ বছর টাকা
জমিয়ে একটা ইউরোপ ট্রিপ করবে। কিন্তু সে আর কই, নিত্যদিনের ঝগড়া থেকে মুক্তি পেতে নতুন
ভাড়া বাড়িতে এসে ওঠা, আর ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কের আরো অবনতি। ইচ্ছাটা ইচ্ছাই থেকে গেছে,
ছেড়ে গেছে অনেকখানি নিস্তব্ধতা আর একাকীত্ব।
রাতদুপুরে পার্থর ফোন বেজে ওঠাটা বেশ একটা অনিয়মিত ব্যাপার।
জেগে থাকে কিন্তু ফোন নিতে ঘাঁটাঘাঁটি ওই রাত দুপুরে একদমই না পসন্দ। গেল বুধবার রাতে
ফোন বেজে ওঠার পরে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ধরে বললো,
-
কি হয়েছে? এতো রাতে কেন আবার!
-
খেলা দেখছিস মদন?
-
না, বললামই তো বিকালে, দেখবো না।
-
কি অবস্থা, এই নাকি সাপোর্টার।
-
হুম। মেলা না বকে কোনো কাজের কথা থাকলে
বল।
-
কি করছিস এতো রাতে?
-
আইরিশম্যান দেখছি।
-
ওসব না দেখে তোদের টিমের খেলা দেখ।
কি খেলছে রে!
-
আবার চাটছিস তো? এসব ভালো লাগে না আমার
সেটা খুব ভালো করেই জানিস তুই।
-
আরে না ভাই, সিরিয়াস! একবার দেখ কি দারুণ খেলছে।
-
তোর দারুণ তো! মানে ফ্রেডের গাদা খানেক
মিসপাস, লিন্ডেলফের হেড মিস, আর র্যাশফোর্ডের গোল মিস। বুঝে গেছি আমি! ঘুমাতে
গেলাম।
-
আরে মদন! দেখ না বলছি।
-
আচ্ছা, ওকে।
সুমিতের কথায় কিছুটা বাধ্য হয়েই সেদিন টিভির সামনে
বসেছিল, তখন খেলার বয়স মিনিট ৩৫। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, দেওয়ালে
পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা টিম কিভাবে এই খেলা খেলতে পারে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে
কিন্তু তখনই একটা অসামান্য ফ্লিকে মাথায় টটেনহ্যাম জালে বল জড়িয়ে দিতেই আবার সেই
সহজাত ভঙ্গিমায় মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো,’ধুর শালা। রোজ রোজ সেই একই জিনিস, ভালো
লাগে না...’। কিন্তু সেদিন একদিন বিরক্তিটা ছিলো না, হয়তো কোথাও যেন আশা দেখেছিল।
পরের দিন সকালে অফিসে দেখা হতেই দূর থেকে চেঁচিয়ে সুমিত জিজ্ঞেস করলো,
-
কি রে শালা, খুব তো গাল দিলি। ডেকে না দিলে কি হত?
-
মানছি ভালো কাজ করেছিস। কিন্তু এ টিমকে ভরসা নেই, কালকেই দেখবি
যেই কে সেই। আমি এসব প্লেয়ার দের ভালো করে চিনি।
-
কি বেইমান রে শালা, এই নাকি তুই সাপোর্টার!
-
আমার জায়গায় থাকলে বুঝতিস।
-
আমি আর্সেনালের সাপোর্টার। আর কিছু?
-
সেটাও ঠিক বটে।
-
খেলা দেখ, এঞ্জয় কর; বেশি ভাবিস না। ওসব করে পয়সা আসবে না, নিজের
ভালো লাগাটুকুই সব।
-
সেই, কাটা। এখন কাজ করি বরং।
-
সেই। আবার উইকেন্ড। সামনে সিটি।
-
জানি, কম করে ৪টে সধরে রেখেছি।
-
চাপ আছে বন্ধু, চাপ আছে।
-
দেওয়া না খাওয়ায়?
-
দেখ টুবি হনেস্ট, দেওয়ার। ওদের টিম
দেখেছিস! শালা বাঘ সব কটা।
-
সেটাই তো বলছি। দেওয়া তো দূরস্ত, খাবো
হুলিয়ে।
-
ওদের জন্যে এতোটাও সহজ হবে না দেখে
নিস।
-
দেখা যাক। চ। লাঞ্চে দেখা হবে আবার।
-
হুম শিওর।
শনিবার দিনে কাজ রাখার কিছু ইচ্ছা ছিলো না পার্থর, খেলা
দেখার জন্যেই মূলত; কিন্তু কিছুটা বাধ্য হয়েই কাজ নিয়ে বেরোতে হয়েছিল। নিজের মনকে
মানিয়েছিলো যে আজ কি হবে জানাই আছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। কাজ নিয়ে বেরোনোর আগে
ভেবে নিয়েছিলো হার তো বাঁধাই; কিন্তু মাঝ সপ্তাহের কিছু ব্যাপার যেন কোন ভাবেই সেই
ভাবনাতে শিলমোহর দিতে পারছিলো না। কিন্তু সেদিন হয়তো অদৃষ্টও ভেবে রেখেছিলো ওকে টিভির
সামনে নিয়ে আসবে। কাজটা মিটিয়ে জলদি ফিরে আসার জন্যে ট্যাক্সিতে ঊঠেই এক ঝটকায় টিমলিস্টে
চোখ বোলাতে গিয়ে দেখে পোগবা নেই, আগের দিনের মতোই টিম শুধু একটা ছোট বদল; ইয়ং-এর জায়গায়
লুক শ। সেটা যে কিছুটা ইতিবাচক বার্তা বয়ে এনেছে তাতে কোনো ইতিউতি থাকার কথা না।
বাড়ি ফিরেই টিভির কাছে গিয়ে সেই যে বসেছে সে আর নড়ার
নয়। হেরে হেরে কিছুটা অভ্যস্ত হওয়া চোখের কাছে কিছুটা যেন কষ্টকর লাগছিল এই মিনিটের
মুগ্ধতাগুলো। হজম করতে চেয়েও কোথাও যেন বার বার আটকে যাচ্ছিলো পার্থ। কিন্তু সে এক
আলাদা মুগ্ধতা। পরের পর পাসের মধ্যে থেকেই কাউন্টার পাস নিয়ে সেই যে দৌড় সেটাতেই
যেন বার বার কাঁটা দিয়ে উঠছিলো ওর গায়ে। একবার তো দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে চেঁচিয়ে
বলেই দিয়েছিলো, ‘কাটা শালা, কাটা শুয়োরগুলোকে...’, আরো কিছু বলবার আগেই থেমে পড়েছিলো
এই ভেবে যে পাশের ঘরে মা আছে। বারবার বারবার ভালো করে বল টেনে আনলেও কিছুতেই জালে
ভরতে পারছিলো না ম্যান ইউ। আর কিছু বার তো কপালের ফের। মিনিট ১৫ -২০ এরম চলার পরে হঠাত
কাট করে বাইরে বেরোতে চাওয়া র্যাশফোর্ডকে বেআইনি ভাবে আটকে দেয় বার্নাডো সিলভা। প্রথমে
না দিলেও পরে টিভি রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেয়। আর সেখান থেকেই ১-০। মিনিট খানেক
পরেই আরো সহজ একটা সুযোগ মুহূর্তের হটকারীতায় বাইরে পাঠিয়ে দেয় র্যাশফোর্ড। তার
পরেই ঠিক বক্সের বাইরে থেকে একটা চমৎকার শট গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে সামনে এগিয়ে
গেলেও আটকে যায় পোস্টে লেগে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘ও শিট!’
মিনিট ৩-৪ ধরে সিটির গোলের আরো কিছু গুলিবর্ষণের পরে কাঙ্খিত হাসিটা আসে মার্শিয়ালের
পা ধরে। বিপক্ষ গোলির কিছুটা এক্সপেক্টেশানের আগেই পায়ের জঙ্গলের মধ্যে থেকে একদম
উল্টোদিকের বারপোস্টের দিকে বলটা মারার পরে কিছুটা হতচকিত হয়ে যায় এদারসন। আগের ২৮
মিনিট অভূতপূর্ব খেলে আসা গোলিও সেই দূরত্বটা আর মেটাতে পারেনি। বলের নাগাল পাওয়ার
আগেই পোস্টে আছড়ে বল ঢুকে যায় গোলে। খুশি আর চেপে রাখতে পারেনি পার্থ। সহজাত ভঙ্গিতে
‘ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস’ দিয়েই শুরু হয় উচ্ছ্বাস। মধ্যান্তরে যাওয়ার সময় স্কোরবোর্ডে
২-০ লেখাটা যে কি পরিমাণ তৃপ্তি দিয়েছিল পার্থকে সেটা হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব না।
আমরা তো সবাই জিততে চাই, সব জায়গায়। যখন ফুচকার লাইনে দাঁড়াই তখন খাওয়ার সাথে
সাথে কিন্তু মনে চলতে থাকে সব থেকে বড় ফুচকাটা যেন আমার গালে পড়ে, এছাড়াও প্রথম
ব্যাট, বাসে বেস্ট সিট, বড় চপের ভাগ এসব কিছুর মধ্যে দিয়েই আমাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে জেতার
ইচ্ছা। কিন্তু এই ইচ্ছাটা যখন বাড়তে বাড়তে স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তখনই আমরা
পিছু হটতে থাকি একটু একটু করে চাপে পড়ে। স্বপ্ন ছুঁতে তো সবারই ইচ্ছা করে।
একটা দল রোজ অনুশীলন করে, ম্যাচ খেলতে নামে। আর পাঁচটা মানুষের মতো দলের খেলোয়াড়দেরও
ইচ্ছা থাকে জিতেই মাঠ ছাড়ার। কোনসময় হয়, কোনসময় হয় না। আর সমর্থকরাও চায় জিততে,
প্রতিদিন। এই ইচ্ছা আর ঘটমানতার মধ্যে কিছু ব্যাঘাত ঘটলেই আমরাও পিছু হটি। এটাই তো
স্বভাব আমাদের। ছেড়ে দূরে চলে যেতে থাকি যখন অসহায় মানুষগুলোর সব থেকে বেশি প্রয়োজন
আমাদের। আমরা ভাবিনি, ভাবি না। পার্থ ভাবেনি, অজয় ভাবেনা, পারমিতাও ভাবে না আর।
মধ্যান্তরের পর শুরুটা বেশ নড়বড়ে হলেও পরে সিটির অনবরত চাপ যেন ক্রমাগতই পিছনে
ঠেলে দিচ্ছিলো ইউনাইটেডকে। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে হার্টবিট বাড়ছে পার্থর।
এই বুঝি গেল, এই বুঝি গেল; আর পাল্লা দিয়ে হড়কাচ্ছে ইউনাইটেড। এরম চলতে চলতে ৮৫
মিনিটের মাথায় পিছন থেকে প্রায় রাক্ষসের মতো ছুটে এসে গোল করে চলে গেল ওটামেন্ডি। ব্যাস
হার্টবিট দ্বিগুণ, ফল ২-১। মিনিট ২-৩ পরেই আর একটা দারুণ শট ধেয়ে এসেছিলো ইউনাইটেডের
গোলের দিকে, কিন্তু দ্যা হিয়া দারুণ দক্ষতায় সেবারের মতো পতন রক্ষা করে। অতিরিক্ত
সময় যোগ হয় পাঁচ মিনিট, কিন্তু রক্ষণ আঁটোসাঁটো করতে ইয়ং ততক্ষনে মাঠে নেমে পড়েছে,
আর এই ব্যাপারটাই পার্থর দুশ্চিন্তা বাড়ানোর জন্যে যথেষ্ট। ইষ্টনাম জপতে জপতে
মিনিট চারেক কাটানোর পরে সিটি একটা কর্ণার পায়। সেই কর্ণারটা আর দেখা হয়নি পার্থর।
দুশ্চিনায় মুখ লুকিয়েছিলো সোফায় রাখা বালিশের মাঝে। কিছুক্ষণ পরে শেষ বাঁশি বাজার
সাথে সাথেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা শান্তির হাসি, টিভির পর্দা তখন আর একজনের
হাসির ছবি ধরতে ব্যস্ত। টিম জিতেছে, খুশি সবাই; খুশি ওরা, খুশি পার্থরা।
জেতার পরেই থেমে গেছে সব পুরোনো কথা। সবাই মেতেছে লাল আবীরের খেলায়। এখন যে শহরের
রঙ বদলানোর সময়। ‘ম্যানচেস্টার ইস রেড’। কিন্তু যদি আজ ফল উলটো হতো তাহলে হয়তো এই শহরের
রঙ এক হতো,কিন্তু আবীরের জায়গায় কাটাছেঁড়ার রক্তে। জিততে চাওয়ার নেশায় মানুষ কতই
না কিছু করে, কাউকে রেয়াত করে না। আর আমরা আরো সরে যাই একটু একটু করে, অসহায়কে
একলা ফেলে, হয়তো মনুষ্যত্ব থেকে। ওরা ফিরে এসেছে আজ, কাল এখানে থাকবে কি জানি না, আরো
আগে যেতেও পারে, আবার পিছলে দু কদম পিছিয়েও যেতে পারে; কিন্তু হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলে
হয়তো অনেক ঝড় ঝাপটাই সহজে সামাল দেওয়া যায়।
ম্যাকটমিনে পেরেছে, ফ্রেড ফিরেছে, র্যাশফোর্ড আবার দৌড় শুরু করেছে, ওলে খুশিতে
আকাশে হাত ছুঁড়েছে, গ্যালারিতে স্যার হাসছে; আজ যে বড় খুশির দিন।
“ আই হার্ড ইউ পেন্ট হাউস... ” নট ওনলি হাউস... এন্টায়ার সিটি।
“ম্যাঞ্চেস্টার ইজ রেড”
No comments:
Post a Comment