Monday, 28 May 2018

আর মাত্র মিনিট তিনেক


         


              ২৫শে মে,২০১৪। ভারতীয় সময় রাত প্রায় দুটো কি সওয়া দুটো। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা টিভির আলোতে উদ্ভাসিত ঘরটা থেকে হঠাত বিকট আওয়াজ। গোওওওওওওওওওওওওললললললললল...............



          প্রায় চার বছর আগের কথা, সেবার বিশ্বকাপের বছর,২০১৪। তাই ফুটবল মরশুম একটু আগে আগেই শেষ হওয়ার কথা। জুন থেকেই চলবে একমাস ব্যাপি ফুটবল জ্বর আর আগে আর পরের এক মাস ব্যাপি সেই দেশগুলো নিয়ে চর্চা। ফুটবল নিয়ে কলকাতার অবস্থান নতুন করে বলে বোঝাতে হয় না। দেওয়াল লিখনের সঙ্গে সঙ্গে এই একমাস যাবত আকাশ পর্যন্ত দেখা যায় না লম্বা লম্বা সামিয়ানার মত ফ্ল্যাগের আড়ালে। বড় বাজারের ত্রিপল পট্টির এই কদিন বেশ ভালোই  ব্যবসা হয়। মানে এমনি বছরের তুলনায় বেশ ভালোই আর কি। কোথাও সবুজ হলুদ, কোথাও নীল সাদা(যদিও সেটা এখন আর আলাদা করে বোঝা যায় না), কোথাও আবার হলুদ, লাল আর কালো; মাঝে মাঝে কিছু সবুজ মেরুনও চোখে পড়ে। এই হলো কলকাতার রঙ। ফুটবল, রসগোল্লা, মিস্টি দই, তেলেভাজা মুড়ি, পলিটিক্স আর গান, এই নিয়েই কলকাতা আছে নিজের মতো, সবার থেকে আলাদা হয়ে। এখানে মোহনবাগান পাবেন, ইস্টবেঙ্গল পাবেন, মহামেডান পাবেন। পাবেন ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, আর্সেনাল, বার্সেলোনা, রিয়েল মাদ্রিদ আরো কত কি। যদিও হাল আমলের সাথে পা মেলাতে গিয়ে, “আমি কলকাতার ফুটবল পছন্দ করি না। আমার পছন্দ অমুক দেশের তমুক টিম” এসব বলার চল বেড়েছে, তবুও কলকাতা থেকে সেই খাস ময়দানি ফুটবলের আমেজটা এখনো রয়ে গেছে। শুধু জার্সির রংটা বদলেছে।


           ২৫শে মে, ইউরোপের সব থেকে বড় ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনাল। ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। মুখোমুখি মাদ্রিদের দুই দল। রিয়েল মাদ্রিদ আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। এই আধুনিক নগরপত্তনের আমলে লোকজন মাচা-লোটার সাথে সাথে এদের নিয়েই দেদার চর্চা করছে। তাই খেলা নিয়ে যে উদ্দীপনা থাকবে সেটা খুব স্বাভাবিক, তাও আবার বিশ্বকাপের আগে আগে। তো যাই হোক, পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে মুখোমুখি লা ব্ল্যাঙ্কোস বনাম রোজি ব্ল্যাঙ্কোস। পুরো সাদা জার্সি গায়ে একদিকে রিয়েল মাদ্রিদ, আর অন্যদিকে লাল সাদা জার্সিতে এটিএম। খেলাটা আর পাঁচটা ফাইনালের মত হতে পারত, কিন্তু না। ২০০১ এ জিনেদিন জিদানের হাত ধরে সেই যে খেলা হলো, তার পর আর পাত্তাই নেই। না ফাইনাল না কিছু। আবার ১২ বছর পর সুযোগ এসেছে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। অন্যদিকে এই প্রথম বার ইউসিএলের ফাইনালে রোজি ব্ল্যাঙ্কোস। তাই কিছু করে দেখানোর বাড়তি তাগিদ যেন আলাদা মাত্রা দিয়েছে খেলাটাকে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো লিসবন আবার পর্তুগালের, থুড়ি রোনাল্ডোর ঘরের মাঠ। তাই উত্তেজনা তুঙ্গে। খেলা শুরু হবে ১২টা ১৫ থেকে(ভারতীয় সময়)। লিসবন জেগে, মাদ্রিদ জেগে, সাথে জেগে রয়েছে কলকাতা।

            মাদ্রিদ ডার্বি কখনোই সুখের হয় না, সে দৃষ্টিসুখ হোক বা মানসিক সুখ হোক। ট্যাকটিক্স এর উপর পালটা ট্যাকটিক্সের চাপে খেলার সৌন্দর্যতাই নষ্ট হয়ে যায়। মদ্রিচ,র‍্যামোস,পেপে, মার্সেলো, বেঞ্জিমা, ক্রুস, রোনাল্ডো, ক্যাসিয়াস নিয়ে তারকাখচিত রিয়েল মাদ্রিদের কাছে বেশ খানিক ফিকে পড়ে যায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। গাবি, গোডিন, টুরান, কোকে, কুর্তোয়া( চেলসি থেকে লোনে) নিয়ে তেমন রাশভারি দল গড়তে পারেনি, কিন্তু ডিয়েগো সিমিওনের ক্ষুরধার ফুটবল ট্যাকটিক্সে খুব একটা পিছিয়ে নেই তারাও। আর সাথে কুর্তোয়ার অসাধারন ফর্ম। সব মিলিয়ে ম্যাচ সমান সমান। খেলা শুরু হতেই সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মারামারি শুরু। দাঁত চাপা ডিফেন্স আর শরীরি সংঘর্ষে কোথায় যেন বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলো রিয়েল মাদ্রিদ। ট্যাকেলের পর কড়া ট্যাকেলে যখন রিয়েল জেরবার তখন ম্যাচের সহজতম সুযোগ মিস করলো গ্যারেথ বেল। গোলরক্ষককে এড়িয়ে গিয়েও একটুর জন্যে তিনকাঠি এড়িয়ে গেল বলটা। ম্যাচের বয়স তখন ত্রিশ-একত্রিশ মিনিট। সেই ভুলের মাসুল দিতে হল ঠিক পাঁচমিনিট পর। রিয়েল মাদ্রিদের রক্ষন দেওয়ালে লেগে ফিরে আসা বলকে হুয়ানফ্রান যখন আলতো ছোঁওয়ায় পেনাল্টি বক্সে ভাসিয়ে দিয়েছে তখন ওখানে মজুত আছে দিয়েগো গোডিন। গোডিনকে দেখে ক্যাসিয়াস গোল ছেড়ে এগিয়ে আসে লাফিয়ে ফিস্ট করে বল বের করে দেবে বলে, কিন্তু কয়েক পা এগোনোর পরেই বুঝে যায় যে ভুল হয়ে গিয়েছে, তাই দুর্গ আগলাতে এখনই ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু হায় ততক্ষনে র‍্যামোসের বেড়াজাল এড়িয়ে বল গোডিনের মাথা ছুঁয়ে গোলের দিকে রওনা হয়েছে। ক্যাসিয়াসের দৌড় শেষমেষ কাজে লাগলো না, বল গোলের জাল জড়লো না বটে, কিন্তু ফিরলো গোল লাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরে। গোল। হাজার হাজার সাদা জার্সির নিঃশ্বাস থামিয়ে দিয়ে,খেলার গতির বিরুদ্ধে স্কোরলাইন দাঁড়ালো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ১, রিয়েল মাদ্রিদ ০।  


             খেলায় কোন পরিবর্তন না দেখে বেশ কিছু বদল করা হয় দ্বিতীয়ার্ধে। কিন্তু তাতেও কোন পরিবর্তন নেই। এক গোলে এগিয়ে থাকার দরুন খেলার মাঠটাকে বাসস্ট্যান্ডে পরিনত করে ফেলেছে সিমিওনে। হাফের উপরে একজন রেখে বকি সবাই মিলে গোল আগলানোর শপথ নিয়েছে। বার বার রক্ষন দেওয়ালে আটকে ফিরে আসতে হচ্ছে রিয়েল মাদ্রিদকে। সময় কারোর জন্যে থামেনা। এদিনকেও থামেনি। এক একটা ব্যর্থ আক্রমনের সাথে সাথে চোখ পড়ে যাচ্ছিল ঘড়ির দিকে। হু হু করে সময় বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু স্কোরের পরিবর্তন নেই। নয় জন অতন্দ্র প্রহরী বেষ্টিত রক্ষন দুর্গ পেরিয়ে গেলেও ধরা পড়ে যাচ্ছে শেষ প্রহরীর হাতে, কুর্তোয়া। অসাধারন ফর্মের পরিচিতি যেন বার বার নজর কাড়ছিলো রাত জাগা মানুষগুলোর। ম্যাচ সত্তর থেকে আশি মিনিটের দিকে পা বাড়াতে যাবে ঠিক সেই সময়ই কোমরের একটা মোচড়ে দুজন ডিফেন্ডারকে মাটি ধরিয়ে একবারে অরক্ষিত গোলকিপার। কিন্তু না এবারেও হলো না, বামদিকের নিচের কোনায় বল রাখল বেল। কিন্তু একটুর জন্যে কুর্তোয়ার আঙ্গুল ছুঁয়ে মাঠের বাইরে চলে গেল। একরাশ হা হুতাশের কলরোল বয়ে গেল স্টেডিয়াম জুড়ে।

             এর পরে আরো ১০ মিনিট মত পেরিয়ে গেছে। এখনো রিয়েলের ভাগ্যে শিঁকে ছেঁড়েনি। স্কোরলাইন একই রয়ে গেছে। ম্যাচের বয়স তখন নব্বই মিনিট হয়ে গেছে। অতিরিক্ত সময় আরো পাঁচ মিনিট যোগ হয়েছে। কিন্তু কোন লাভের লাভ হচ্ছে না। একের পর এক ঠিকানা লেখা পাস এসে পড়ছে এটিএম রক্ষনে আর উদবাস্তুর মতো ফিরে যাচ্ছে কোন অজানা ভবিষ্যতের পথে। আর মিনিট তিনেক রুখে দিতে পারলেই ইতিহাস হাসবে নতুন অধ্যায়ের দিকে চেয়ে এই অপেক্ষায় বুক বাঁধছে হাজার হাজার লাল সাদা জার্সি।আর আশা নেই, এই ভেবেই ঘরে ফিরছে অনেক অনেক সাদা জার্সিধারী। কলকাতাতেও অনেক বাড়িতে তখন টিভি সেট অফ। আর আশা নেই, ম্যাচ বেরিয়ে গেছে। লা ডেসিমা আর কবে আসবে এই প্রশ্ন করতে করতেই ইনজুরি টাইমের অর্ধেক প্রায় শেষ। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো একটা কর্নার এলো। আর ভাবাভাবির ব্যাপার নেই, সোজা মড্রিচের কর্নার এসে পড়লো ছ-গজের বক্সের মধ্যে। মিরান্ডা, গোডিন সমেত আরো কজন লাফালো বলের জন্যে। কিন্তু সবাই কে এড়িয়ে বল সোজা খুঁজে নিলো সার্জিও র‍্যামোসকে। চকিতে একটা মাথায় বলে একটা “টিন্ডার ডেট” আর তার পরেই তিনকাঠির দিকে যাত্রা। ঠাস বুননে মোড়া কুর্তোয়ার মোহ এড়িয়ে সেকেন্ড পোস্টের কোনা দিয়ে বল পেরিয়ে গেল গোললাইন। গোওওওওওওওওওওওওললললললললল........... সময়কে স্তব্ধ করে দিয়ে, লাল সাদা স্রোতের পথের বাধা হয়ে নতুন করে প্রানসঞ্চয় হলো স্টেডিয়ামে। ম্যাচের বয়স তখন ৯২ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড। খেলার ফল ১-১। চিৎকার করেছে লিসবন, চিৎকার করেছে মাদ্রিদ, চিৎকার করেছে কলকাতাও।

[ সেই মুহূর্ত ] 



                  এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। নির্ধারিত সময়ের পরে খেলা গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। আর সেখানেই কুপোকাত রোজি ব্ল্যাঙ্কোস। দীর্ঘ নব্বই মিনিট ধরে বাঁধানো জমাট রক্ষন ভেঙ্গে গেলো একটা হেডে। সম্মোহনের জাল এড়িয়ে বেলের হেড গোলে আশ্রয় নিল ফার্স্ট পোস্টের গা ধরে। কুর্তোয়ার ইন্দ্রজাল পেরিয়ে স্কোর গিয়ে দাঁড়ালো রিয়েল মাদ্রিদ ২ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ১। এর খানিক পরেই কুর্তোয়ার হাতের তলা দিয়ে বল গোলের জালে জড়িয়ে গেলো। ফল ৩-১। এবারে মার্সেলোর অবদান। রোজি ব্ল্যাঙ্কোসদের বুকভাঙ্গা কান্নার আওয়াজ তখন চাপা পড়ে গেছে সফেদ ঝড়ে। অ্যাটলেটিকোর কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। ব্যাস ভবলীলা সাঙ্গ। স্কোরলাইন ৪-১ আর ঘড়িতে সময় একশ সতেরো মিনিট। বাকি আর মাত্র তিন মিনিট। বিধস্ত রোজি ব্ল্যাঙ্কোস এই আঘাতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে কেমন দিক হারিয়ে ফেললো। মাথা গরম করে ভুলভাল পা চালানো, শরীরি সংঘর্ষ তারই পরিনাম। রনক্ষেত্রে কাটানো তিন মিনিটের শেষে রেফারির বাঁশির সুরে ভবলীলা সাঙ্গ। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া লাল সাদা জার্সির মাঝে জ্বলজ্বল করছে ৪-১ এর স্কোরলাইনটা। লিসবনের রাতে রিয়েল মাদ্রিদের দশম চ্যাম্পিয়ান্স লিগ জয়। কাছে পিঠের প্রতিদ্বন্দী বলতে এসি মিলান, তার পরে সেই দূরে লিভারপুল, বার্সেলোনারা আছে।

                  সময়ক্রমে যদি ২০১৪ থেকে ২০১৮ তে ফিরে আসি তাহলে দেখবো এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। পেপে আর দলে নেই, ডি মারিয়া অন্য দলে, কোচ পালটে গেছে। আর সর্বোপরি রিয়েল মাদ্রিদের ট্রফি ক্যাবিনেটে আরো ৩টি ইউসিএল জমা হয়েছে। কিন্তু আজকেও সেই লা ডেসিমার মাহাত্ম্যটা রয়ে গেছে। হারের মুখে ভেঙ্গে পড়া একটা টিমকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে স্বপ্ন দেখানো মানুষটাই এর জন্যে দায়ি। কি ক্ষতি হতো সেদিন যদি কাপ না আসতো, কিন্তু মানুষটা তো টিমের জন্যে নিবেদিত প্রান। দলের ভালোর জন্যে অন্যটিমের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতেও পিছপা হয় না। রঙ মাখানো কার্ডের তোয়াক্কা না করেই নিঃশর্ত ভাবে ভালোবেসে যায় টিমকে। নিন্দুকেরা বার বার তার মস্তানি ভঙ্গিকে প্রশ্ন করেছে, কার্ডের পিছনে লুকিয়ে সমালোচনা করেছে। গোলটার কথা স্বীকার করেছে ঢোঁক গিলে। গালিগালাজও মানুষটার নিত্যসঙ্গী। যে যাই বলুক, ওদের কথায় কান না দিয়ে তুমি এগিয়ে যাও ক্যাপ্টেন। ওরা দেখবে আর জ্বলবে, লুচির মতো ফুলবে। এরম আরো গোলের আশায় থাকলাম,



                   মিঃ ৯২ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড… মিঃ সার্জিও র‍্যামোস… এল মায়েস্ত্রো।।






4 comments:

  1. Khub Valo Vai......KhuuuuB valo....
    Mon Chuye gelo..

    ReplyDelete
  2. দর্শনীয়.. অভাবনীয়.. রক্তচাপ উঠন্ত..

    হালা মাদ্রিদ এবং জয় মোহনবাগান |

    ReplyDelete

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...