তুলনাটা কেমন যেন
আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। ছোট থেকে বড় সব কিছুতেই কেমন তুলনা। এটা যে
শুধু হালের আমদানি এরম ভাবাটা খুব ভুল। এসব আগেও ছিল, এখনো আছে। শুধু পরিসরটা বদলে গেছে। আগে পাড়ার মীনা কাকিমার মেয়ে হয়েছে আর আমার
কাকিমার ছেলে থেকে হাল আমলে আমার ফেসবুকের লাস্ট ডিপিটায় সৌরভের ডিপির থেকে বেশি
লাইক পড়েছে পর্যন্ত সব কিছুতেই মুড়ি চানাচুরের মত তুলনা রয়ে গেছে। তো এসব লিখছি
মানে এরম ভাবার কোন কারন নেই যে আমি তুলনা করি না, আমিও করি। আমায় ওমন সাধু পুরুষ ভাবার বিশেষ অবকাশ আমি দি না।
মার্চের শেষের
কটা দিন আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম, তাই ওখানকার জল হাওয়া
নিয়ে লেটেস্ট কোন আপডেট নেই। তবে ফিরে আসার আগে ত্রিশ-পয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই উষ্ণ বাতাসের আনাগোনা জানান দিয়েছে তার উপস্থিতি। হাড়
কাঁপানো ঠান্ডার সাথে সাথে এবার যে চাঁদি ফাটানো গরমটাও পড়বে সেটা বেশ বোঝাই
যাচ্ছে। এখন চৈত্র সেলের পোস্টার ছাড়া চৈত্র মাস আর বোঝা যায় না। সবটাই গরম, গরম আর গরম। তো সেসব বাদ দিয়ে সামনেই পয়লা বৈশাখ। সেটা নিয়ে বরং একটু গল্প
জমানো যাক।
১) আজকালকার বাঙালি
ছেলে মেয়েদের কাছে পয়লা বৈশাখ, 'উগাদি', কলার কাঁদি ইত্যাদি হয়ে গেছে। আর এটার অন্যতম কারন হিসাবে বলা যায় এই বাংলার
বুকে আশা নেই কাজ খুঁজে। সবাইকেই কাজের জন্যে হয় উত্তর বা দক্ষিন বা পশ্চিম ভারতে
থাকতে হচ্ছে। কাজে কাজেই পয়লা বৈশাখে ছুটি নেই, তাই উগাদিতেই
খুশি। আমাদের সময়ে পয়লা বৈশাখ মানে অফিস আদালত ছুটি, পাশের বাড়ির মালতি কাকিমাদের দোকানের পুজো। সকালে চা সিন্নি থেকে শুরু করে
দুপুরে আলুর দম, ধোঁকার ডালনা অবধি মেনু পুরো মুখস্থ। আহা সেসব
কি দিন ছিল, আজ কাল কার ছেলেপুলেরা ওই উগাদি নিয়েই মাতুক; পোহা,
ধোসা, ইল্লে কুরকুরে, ছাতার মাথার চচ্চড়ি এসবই খাক।
২) এ তো গেল যারা পশ্চিমবাংলার বাইরে নির্বাসিত, এবার আসি ভেতরের
মানুষগুলোর কথায়। আজকালকার ছেলেপুলেগুলো কি যে চাকরি করে কে জানে। পয়লা বৈশাখেও
নাকি ছুটি নেই। লাল মুখোদের
কেরানিগিরি করেই নিজেদের আভিজাত্যটা খোয়ালো। পয়লা বৈশাখেও নাকি ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট এঁটে অফিসে যায়। আমাদের সময় আমরা তো সরাসরি
বলেই দিতাম যে আসতে পারবো না, যদি বলতো পয়লা বৈশাখে
হাজিরা মাস্ট। মামদোবাজি নাকি! পাঞ্জাবি, পায়জামা
একদম মাস্ট। ধুর ধুর এরা এসবের মজাই পাবে না।
৩) হালখাতার মজাটা মনে পড়ে? অ্যাঁ, বলেন নি মশাই। এসব প্যান্টুলুন আঁটা ছোকরার
দল এসবের মজা জানবে...!! আমাদের সময় এর মজাই ছিল আলাদা। অত পেতে বসে থাকতাম। মালতি
কাকিমাদের বাড়ি ভর পেট খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়েই বিকাল বিকাল বেরতাম এই দোকান সেই
দোকান। মিস্টির প্যাকেটে নজর তো থাকতই,সাথে সাথে মজা ছিল রকমারি ক্যালেন্ডারের।
কোন দোকানে কি মিস্টি দিল, কার ক্যালেন্ডারটা বেস্ট, কোন দোকানে কি সরবত খাওয়ালো
এটা ভাবতে ভাবতেই দিন দুই চলে যেত। এখনকার ছেলে মেয়ে গুলো ওই ওয়াটস্যাপ ফেসবুকেই
গুগুল থেকে “শুভ নববর্ষ” লেখা ছবি দিয়েই কাজ সেরে দেয়। এসবের সময় কোথায় তাদের।
৪) কলকাতায় আছে, ভাগ্যবশত অফিস ছুটি পেয়েছে বা পয়লা বৈশাখ ছুটির দিনে পড়েছে
তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। ছেলে ছোকরার দল সোজা ভিড় জমাবে গড়িয়াহাটের দোকানে। হাতে
কাঁচা টাকার তো তেমন অভাব নেই, তাই কার্পণ্যেরও বিশেষ বাহুল্য নেই যদি না স্বভাব
হয়ে থাকে। একখানা লাগদাই পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে সোজা প্ল্যানিং। সকাল থেকে কি কি হবে,
কোথায় খাওয়া হবে, কাদের সাথে বেরোনো হবে একদম পরের পর সাজানো। বাকি দিন সকাল সকাল
টিভি,রেডিও বা মিউজিক সিস্টেম চলুক বা না চলুক; ওইদিন এগুলো মাস্ট। সোজা চালিয়ে
দিয়ে “এসো হে বৈশাখ” দিয়ে শুরু। পরে আরো কিছু চলবে, সেগুলো অতো ইম্পর্ট্যান্ট না
হলেও এই গানটা থাকতেই হবে। তারপরেই প্ল্যান মাফিক সোজা ভজহরি মান্না, বা সিক্স
বালিগঞ্জ প্লেসের বাইরে ঘন্টা দুই লাইন; আর শেষে গলদ্ঘর্ম হয়ে বাঙালি খাবার খেয়ে
উজ্জাপন। আর কি চাই, পুরো মাখন প্ল্যান। সারা বছর বাংলা বলতে লজ্জা পাওয়া ছেলে
মেয়ে গুলো কেমন রাতারাতি বাংলায় কথা বলবে, দেখেও ভালো লাগে। আমাদের সময় এসবের তো
বালাইবাষ্প ছিল না। নিমন্ত্রন থাকলে তো মিটেই গেল, না হলে সকালে ছোলার ডাল আর লুচি
দিয়ে শুরু, শেষ হবে চিংড়িমাছের মালাইকারি দিয়ে। না আছে ওই ভজহরি না আছে ওই
বালিগঞ্জ। সবই কেয়ার অফ মায়ের হাত।
এ তো গেল “আমাদের সময়” আর “আজকালকার ছেলে মেয়েদের” তফাত। এবার প্রশ্ন হল তাহলে
কে ঠিক আর কে ভুল। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একপ্রকার অসম্ভব। আসলে কেউই জানি না কে
ঠিক আর কে ভুল। সময় বদলেছে, কাল বদলেছে। পয়লা বৈশাখের আবেদনটাও বদলেছে দিনে দিনে।
বাংলা মিডিয়াম স্কুলের বেঞ্চিগুলো যখন হাপিত্যেস করে ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে তাকিয়ে
থাকে তখনই তো বদলে যায় এই ছোট ছোট আবেদনগুলো। তাই কে ভুল, কে ঠিক সেই বিচারে
শক্তিক্ষরন না করে যে ভাবে চলছে সেভাবেই উপভোগ করাটাই ভালো নয় কি??
No comments:
Post a Comment