Saturday, 30 December 2017

অনুরাগ



দীর্ঘ ভয়, দীর্ঘ শোক, দীর্ঘ অসুখ তার,
অভিসম্পাতে প্রিয় গান হয়ে
ফিরে আসো বার বার।

বাইরে শীতের রোদের আমেজে উলের ছোঁওয়ার রেশ,
ক্যাপুচিনো হাতে নিয়ম মানাতে
তুমিই জানো বেশ।

দেওয়াল জুড়ে সাজিয়ে যতনে, মুহূর্তগুলো বন্দী,
চেনা মাফলারে এড়িয়ে চলা
তোমার আদিম ফন্দী।

একা সোয়েটার, দীর্ঘমেয়াদী- ডার্ক সার্কেলে বোনা,
তোমায় ছেড়েছি তোমারই জন্যে
তাই প্রিয় যন্ত্রনা।

দূর থেকে প্রেমে জন্মবদল, আবার ফিরবো দেখো;
ততদিন তুমি আবেগী বাষ্পে
পরিনত হতে শেখো।

কথায় কথায় তর্কের সাথে দুরত্ব বাড়ে যত
প্রেমটা জমে শীতের দিনে
নলেন গুড়ের মতো।

প্রেমের মধ্যে যুদ্ধ অনেক, অভ্যেস বারোয়ারি;
আবার আমরা মিলবো যখন
ফিরবো তোমার বাড়ি।

আঙ্গুলে আঙ্গুলে রটে যাবে ফের এই কাছে আসাআসি,
নুনের কৌটো বুঝে যাবে শেষে
আসলে ভালোই বাসি।

প্রেমের আঁচে,অধিকারে বাড়ে ঠোঁটের নীচের ব্রন
তোমাকে ফেলবো, ভাঙবো
তবু ছাড়বোনা কক্ষনো।




Sunday, 17 December 2017

ম্যান অফ স্টিল

            

             ম্যান অফ স্টিল লেখার নামটা পড়েই এক ঝলকে কার্টুন দুনিয়ায় কিংবা জ্যাক স্নাইডারের সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যায় সবাই হয়তো কানেক্ট করতে পারবে না, তবে হালের সব ছেলেপুলেরই নখের ডগায় এসব জিনিস লেখার নামটা পড়েই সেই প্যান্টের উপর জাঙ্গিয়া পরা, পিঠে চাদর আঁটা মানুষটির কথা মনে আসে সবার আগে, কিন্তু এটা সেই ব্যাপার না ওই সিনেমার গাল গল্পের মতো এরম রুপকথা নেই এখানে, এখানে আছে বাঁচার গল্প, প্রতিষ্ঠার রুপকথা গল্পের নায়ক উড়তে পারে না, ছুটতে পারে হাওয়ার মতো চোখে তার নেই লাল লেজারের ঝলকানি, রয়েছে ফিরে আসার অঙ্গীকার এরম একটা ফিল্মি মানুষ নিয়েই আজ কিছুটা টাইম কাটাবো আস্তে আস্তে আলো গুলো ডিম করে দি, আর লাইটক্যামেরাএন্ড আকশান



                             ট্যারাট্যারাট্যারা… !!


কখনও চলতে চলতে হাঁটু আটকে পড়ে গেছেন? বা অনেকটা জোরে চলতে থাকা গাড়িকে হঠাত ডিস্কব্রেক লাগিয়ে থামিয়েছেন? যদি করে থাকেন তখন বুঝতেন যে কি পরিমান কষ্ট হয় হাঁটু হলে তো এমন যন্ত্রনা হবে যে অন্নপ্রাশনের মাছে রসুনের গন্ধের সাথে পায়েসের ঢেঁকুরটার কথাও মনে পড়ে যাবে, আর গাড়ি হলে তো ব্রেকটাই ফেল করে যেতে পারে বছর পনেরোর ছেলেটার সাথেও এরমই হলো বাঁদিকের ফ্ল্যাঙ্ক ধরে যে দৌড়টা শুরু করেছিলো, অচিরেই থেমে যেতে হলো অফসাইডের চোখ রাঙ্গানিতেরেসিং হার্ট উচ্ছলতায় ভরা কচি প্রানটা কখন যে ছুটতে ছুটতে হার্টটাকেও লাগাম ছেড়ে ছুটিয়েছে কেউ বুঝতেই পারেনি

-       আজ থেকে খেলা বন্ধ এই হেলথ্কন্ডিশানে এই রিস্কটা নেওয়া সম্ভবই না একটা বেছে নিতে হবে হয় প্রান নয় ফুটবল

মায়ের কাছে এরমই শাসানী দিয়ে রাখলো ডাক্তারেরা মায়ের মন, পড়েছে দোলাচলে একদিকে ছেলের জীবন অন্য দিকে ছেলের জীবনী শক্তি পছন্দের,অপছন্দের মধ্যে বিচার করা সোজা, কিন্তু দুটো পছন্দের মধ্যে একটা বেছে নেওয়া খুবই কষ্টের মা পারেনি ছেলে কে আটকাতে ছেলে যে ভালোবেসেছে; আর ভালোবাসা থেকেই জন্মেছে অধিকারঅফসাইডের ফ্ল্যাগের দিকে চোখ তুলেই শুরু হলো দৌড়

-       কিন্তু এভাবে চললে যে আর বাঁচানো যাবে না ছেলে কে

এর ঠিক কয়েকটা বছর আগে মানে ছেলেটার বয়স তখন ১১-১২, রেসিং হার্টের চিন্তা তখন মাথাতেই নেই। সিডি ন্যাসিওনাল  তখন ধুঁকছে দেনার দায়ে। নয় নয় করে ২২০০০ পাউণ্ডের ধাক্কা। কোনো ভাবেই ফেরাবার উপায় নেই। অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে অ্যালবার্ট ফ্যান্টাউ আর ছেলেটাকে তুলে দিতে চাইলো স্পোর্টিং লিসবনের হাতে। কিন্তু সিট খালি একটাই। কে চড়বে সেই বাস, এই নিয়েই দ্বন্দ্ব। শেষমেষ ট্রাইব্রেকার হিসাবে একটা ম্যাচের আর্জি জানানো হলো। রেফারির বাঁশির সাথে শুরু দৌড়। চোখে নতুন স্বপ্ন, মাথায় দেনা মেটানোর দায়িত্ব যেন কোনো ভাবে নাড়াতে পারছিলো তাদের। প্রথম গোলটা করার পর লম্বা একটা দৌড়, স্বপ্ন বুঝি সত্যি হলো। পরে আবার গোল, এবার অ্যালবার্ট। দুজনের পাল্লা ১-১। শেষের বাঁশি প্রায় বাজলো বলে, তারই খানিক আগে অ্যালবার্ট গোলকিপার কে কাটিয়ে নিয়েছে, সামনে খালি গোল। কিন্তু না, সে এগিয়ে দিলো ছেলেটার দিকে। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বলটা পায়ে এলো আর নিমেষে জালে জড়িয়ে গেলো। স্বপ্নপূরন। ম্যাচের পর জিজ্ঞাসা করে সে, “আমায় কেন বলটা দিলি? তুই তো নিজেই মারতে পারতিস, চলে যেতিস লিসবন।” উত্তর এসেছিলো, “তুই আমার থেকে অনেক ভালো রে।” এক অবর্ননীয় ইতিহাসের শুরু। পর্তুগালের মাদেইরার অ্যাভিয়েরো পরিবারে তখন শোকের ছায়া। ছোট ছেলে কে যেতে হবে অনেক দূরে, সেই লিসবন। একা ছেলেটা দমেনি তাতেও। একা একাই প্রস্তুতি নিয়েছে বৃহত্তর যুদ্ধের।

এর কয়েকটা বছর পরেই ধরা পড়ে রেসিং হার্ট। খেলার ভবলীলা সাঙ্গ। বহুলোকে বারন করেছে,শোনেনি কিছুই ডাক্তার বদলেছে, ওষুধ বদলেছে আরো কত কি কিন্তু খেলে সে যাবেই অপারেশান হলো অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই অপারেশানের কিছুদিন পর অব্দি বিশ্রাম, তার পরে আবার যুদ্ধ শুরু



গ্যারোথ ম্যারাভিলিয়োসো     টু       দ্যা  ডিউক



এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি, তরতরিয়ে নৌকা ছুটেছে। ডানদিক, বাঁদিক মিলিয়ে একেবারে থরহরিকম্প ডিফেন্ডারগুলো। ছিপছিপে বেতের মতো চেহারা, সর্পিল চোরা গতি, বলের ওপর দিয়ে রাজনিকান্ত স্টাইলে পা ঘুরিয়ে হাপিস হয়ে যাওয়া এসব যেন জলভাত। এর ওপর আস্তিন থেকে বের করেছে বিষাক্ত সব শট আর ফ্রি-কিক। কিভাবে আটকাবে সেই নিয়ে হিমশিম সবাই। বেশি গোল করেনি, কিন্তু করিয়েছে অনেক। কানে কানে কথা ভেসে সাগর পেরিয়ে পৌঁছালো ইংল্যান্ডেও। আর কাকতালীয় ভাবে এর কয়েক দিন পরেই ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড খেলতে আসে লিসবনে। টানটান ম্যাচে চোখ শুধুই ছিলো একজনেরই দিকে। জহুরি তো জহর চেনে। ম্যাচের পর সব প্লেয়ারদের কথা শুনলেও জহরতো কখনো হারাতে দেন নি চোখের থেকে। ইংল্যান্ডে ফিরেই জলদি কাগজ পত্তর পৌছে যায় পর্তুগাল। রেকর্ড অর্থের বিনিময়ে লিসবন থেকে প্লেনে ওঠার টিকিট কাটলো ছেলেটা। ১২.২৫ মিলিয়ন ডলারে সেদিন সই করেছিলো। অর্থের নিরিখে অনেকটা বড় হলেও একবারও দ্বিধা করেনি ‘বিগ বস’(পড়ুন স্যার আলেক্স ফার্গুসন)। স্বপ্ন গুলো আস্তে আস্তে বড় হলো, রঙ বদলালো। সাদা সবুজ থেকে লালে রাঙ্গা হলো। জন্ম নিলো “ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো”।


            
             [ নিকি বাট-এর পরিবর্তে মাঠে আসছে রোনাল্ডো ]


উপরের ছবি দিয়েই শুরু, বাকিটা ইতিহাস। একের পর এক ডিফেন্ডারকে ঘায়েল করে তখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে রনি( রোনাল্ডোর ডাকনাম)। এদিকে চেলসিও দিনে দিনে দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে ডিফেন্সে, জন টেরিকে সামনে রেখে। জন টেরিকে পেরোনো মানে চিনের প্রাচীরর এক লাফে টপকে যাওয়া। তাই লড়াই আরো জমে উঠলো দিনে দিনে। চেলসির কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতার পর সব কিছুর অবসান। চ্যাম্পিয়ান্স লিগের ফাইনালে চেলসিকে পর্যুদস্ত করে ইউরোপ সেরার শিরোপা তখন রনির হাতে। সেরার হাতে সেরার শিরোপা।


                  
[ প্রথম ব্যালন-ডি-ওর হাতে রোনাল্ডো ]



এই শুরু প্রথম ব্যালন-ডি-ওর ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় তখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সারা দুনিয়ার তখন নজর এই হীরের দিকে সবার ধান্দা ঝোপ বুঝে কোপ মারবে আর কি বেশিদিন আগলে রাখা যায়নি ২০০৮ সালে বার্সেলোনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও ফেরানো যায়নি রিয়াল মাদ্রিদের প্রস্তাব ততকালীনলা গ্যালাকটিকোরসুখ্যাতি ভাঙ্গিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ তখন সবার কাছে স্বপ্নের মতো তার উপর আবার রাউল গঞ্জালেসের পাশে খেলার সুযোগ কোনোটাই ফেলতে দেয়নি আর বিগ বসের সায় নিয়ে, আরো নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় এবার নতুন দেশ, স্পেন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ
রেকর্ড ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডে স্পেন জয়ে বেরোলো রনি, ততকালীন ইংল্যান্ড সম্রাট




ফ্রম   এল-মায়েস্ত্রো    টু     এল-মেজর




বাড়া ভাতে কে যে ছাই দিলো কে জানে। ভাবের ঘরের বিলাসী হলো পরের বাড়ির ঝি। কিছুতেই ভালো সময় আর আসে না। দেশ বদলেছে, পরিবেশটাও বদলেছে। ইংল্যান্ডে তখনো “রোনাল্ডো ফিরে এসো” বলে আওয়াজ তোলে, বিরোধিদের চিন্তা এই বুঝি ফিরে এলো,তাহলেই পণ্ডশ্রম। এদিকে নতুন জায়গা, নতুন মুখ, নতুন করে সিংহাসন গড়ার চ্যালেঞ্জ। স্পেন জুড়ে তখন রাউল গঞ্জালেসের জন্যে বন্যা আসার জোগাড়। এই বুঝি সময় ঘনিয়ে এলো, তার উপর আবার রোনাল্ডো এসে গেছে, সতীনের চোখে তাকানোটাই স্বাভাবিক। লোকে বলে দলের প্রধান প্লেয়ার নাকি ১০ নাম্বার জার্সি পরে খেলে। ওসব ধার ধারে নে রনি। পছন্দের জার্সি ৭। এই নাম্বারেই পরিচিতি, এই নাম্বারেই খ্যাতি, “সি.আর. সেভেন”।  না ৭ পেলো না, ওটা যে রাউলের গায়ের মাপে বানানো, কাউকে তো দেওয়া যাবে না স্যান্তিয়াগো বার্নাবিউ-এর দর্শক হিসাবে সুখ্যাতি কোনও কালেই নেই তবুও রাউল যেন হঠাত করেই আরো কাছের হয়ে যেতে লাগলো একটু থমকালো বুঝলো এই স্প্যানিশ আর্মাডাকে ভাঙ্গা সহজ হবে না আবার শুরু হলো লড়াই এগারো বছর বয়সে যে ছেলে বাড়ি ছেড়ে এসে ফুটবল আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারে সে যে এতো সহজেই দমে যাবে সেটা আশা করাই ভুল নিন্দুকদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে আবার শুরু হলো পরীক্ষা, লড়াই এবার অনেক শক্ত



                    
[প্রথম দর্শন মাদ্রিদে]     



এই ভাবেই শুরু পথ চলার। খচা খচ ফ্যাশের আলো আর দেঁতো হাসির আড়ালে সবার চোখ এড়িয়ে গেলো কঠিন প্রস্তুতিটা। সঙ্গী এবার নাম্বার নাইন।


        কোনো জিনিস প্রথম বারেই যদি খারাপ হয়ে যায়,তাহলে কুনজর পড়ে যায় সেদিকে। এই যেমন আপনি একটা ছাতা কিনলেন আর বর্ষার প্রথম কাছাখোলা বৃষ্টিতেই আপনারও কাছা গেলো খুলে। ব্যাস ছাতা গন। এবার আপনি বলুন, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে না কিছু রামায়ন বানী? ব্ল্যাক লিস্টেড হবে না দোকানদার? এখানেও অবিকল এক ব্যাপার। অপয়া, ওভার রেটেড, আরো কতো কি শুনতে হয়েছে। তার ওপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হলো বার্সেলোনার লিওনেল মেসি। দুনিয়ার কাছে সে এখন পরিচিত। ইতিমধ্যেই ঝুলিতে ভরেছে একটা ব্যালন ডি ওর। মন্ত্রমুগ্ধের কেউ কেউ তো ভগবান বলে ডেকেও ফেলেছে, অনেকে আবার খুঁজছে মারাদোনাকে। তাই দুই মহা তারকা একে অপরের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার মতো দুরত্বে থাকলে তুলনা যে আসবে সেটা অবশ্যম্ভাবী। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। কফিকাপে, চায়ের আড্ডায় কিমবা টিভির রিমোটের সাথে চলছে তুমুল তর্ক আর তুলনার বহর। এ বলে আমি, তো ও বলে আমি। তবে এখন স্কোর ১-১। 

বছর গড়ালো, কিন্তু ছবি বদলালো না। ২০১০, আবার মেসি। ঝোলায় আরো একটা ব্যালন ডি ওর। স্কোর তখন ২-১, হারছে রনি। ২০১১, সেই এক ছবি। বদলায়নি  কিছুই । আবারও মেসি। হুড় হুড় করে এগিয়ে চলছে স্কোরবোর্ড। আবারও গোল খেয়ে গেলো রনি। নিয়ম মতো প্রতিবারই ফিফা বছরের সেরা টিম প্রকাশ করে এই প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশানে। নাম উঠছে প্রতি বারেই সেরা দলে, এমন কি সেরা তিনেও আসছে বার বার। কিন্তু শেষমেষ সেই ভাঁড়ে মা ভবানী। বিরক্ত হয়ে যাওয়াটাই খুব স্বাভাবিক, রনিও হলো। ২০১২, সেই চর্বিত চর্বন। গোলের পর গোল খেয়েই যাচ্ছে, স্কোর ৪-১ এ পিছিয়ে। কানাঘুষোও এলো, আর কি দোকান খুলবে? কিন্তু হার্টকে সামলে রাখতে পারে যে ছেলে, তাকে দমায় কার বাপে...!! চোয়াল শক্ত করে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু আবার, নতুন করে, নতুন ভাবে। কথায় আছে খোঁচা খাওয়া বাঘ নাকি এমনি বাঘের থেকে অনেক বেশি হিংস্র, আর এই ক্ষত যে অনেক গভীর, বছর খানেকের; সহজে কি রাগ মেটে...!! ছিঁড়ে খুঁড়ে রেখে দিলো ডিফেন্ডারগুলোকে, বছরের শেষে ঝুলি ভরা ৬৯ গোল, আসে পাশে অন্তত বেশ খানিক দূর অবধি কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেখানেও বিপদ। সামনে ২০১৪ বিশ্বকাপ, পর্তুগালের মাথায় ঝুলছে খাঁড়া। আদৌ কি যাবে মূলপর্বে, পারবে তো, এসব প্রশ্ন কেমন যেনো আচমকাই ঘনীভূত হয়ে গেছিলো। পেপারে পেপারে হেডলাইন,” রোনাল্ডো কি পারবেন?” ,“রোনাল্ডোর পরীক্ষার শেষ রাত?”, “পারবেন কি হতে পর্তুগালের নায়ক?”; আরো কতো কিছু। “হাতি যখন পাঁকে পড়ে, চামচিকিতেও লাথি মারে”। এসব দিকে মন না দিয়ে নজর প্লে অফ।

          সব সিনেমার শেষ যদি হরনাথ চক্রবর্ত্তির সিনেমার মতো ন্যাতানো মুড়ি মার্কা হয়, কারো ভালো লাগবে? মানে ধরুন কেট উন্সলেট  আর লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এর যুগলবন্দী কোনও মুভিতে লাস্ট সিনে “চোখ তুলে দেখো না কে এসেছে” এই গানটা বাজছে, তাহলে মানাবে??? তেমনি টাইগারের জন্যেও একটা পাকা হাতের স্ক্রিপ্ট না হলে হয়...!! সেটার দ্বায়িত্ব অবশ্য ভগবানই নিয়ে নিলেন। ২০১৩, ওয়ার্ল্ড কাপ প্লে-অফ, পর্তুগাল বনাম সুইডেন, বকলমে রোনাল্ডো বনাম জ্‌লাটান ইব্রাহিমোভিচ।  ১৫ই নভেম্বর, এস্তাডিও লিসবনে প্রথম দেখা(ঘরে বাইরে নিয়মে খেলা) খেলা শেষ হলো ১-০ হয়ে, ত্রাতা সেই রোনাল্ডো কিন্তু এতেই শান্ত হলে তো হবে না, পরের লড়াই যে বাইরে আরো কঠিন কিছু বুঝি অপেক্ষা করে আছে একগোল যে কোনও ভাবেই সেফ না সেটার অনুমান ভালোভাবেই ছিলো রনির ১৯ তারিখ, ফ্রেন্ডস এরিনা- সোলনাতে আবার মুখোমুখি। এবার প্রতিশোধের পালা। কালো মাথায় ভরা স্টেডিয়ামটা যেনো হলুদে মুড়ে ফেলা হয়েছে। শব্দব্রহ্মের মধ্যেই বাজলো রেফারির বাঁশি। শুরু হলো লড়াই।  প্রথম হাফ, গোলশূন্য উত্তেজনার পারদ চড়ছে সেকেন্ড হাফ শুরু হতেই গোল দাগলো রোনাল্ডো ব্যাস আর রাখে কে, উৎসবের জোগাড়যন্ত্র তখন শুরু হচ্ছে পর্তুগালে কিন্তু না, আবার গোল; এবার জ্লাটান, - থিতু হয়ে গেলো একটু খুব টেনশান কিছু চোখ তখন মাঠে আর অনেক গুলো মাঠের বাইরে কেউ হাতের নখ বের করে, কেউ আবার হাত জড় করে টেনশান বাড়তে বাড়তেই হঠাত করে গোল, জলাটান আবার অনবদ্য কিকে জালে জড়িয়ে দিয়েছে ১-২ সবাই ভাবছে আর ২০ মিনিট মতো বাকি, আর কি কিছু হওয়া সম্ভব...!!! যেমনি ভাবা, ঠিক শোধ দিয়ে দিলো -, আবার রোনাল্ডো মনে মনে আনন্দ শুরু হচ্ছে যখন ঠিক তখনই একটা অনবদ্য কাউন্টার অ্যাটাক পলক পড়ার আগেই দুরন্ত গতি বলকে টেনে নিয়ে চলে গেলো অন্য পাসে এক লহমায় গোলকিপারকে টপকে বল জালে মুহুর্তের মধ্যে সব যেন কেমন থেমে গেলো, স্লো মোশানে ছুটছে দল। স্পিড বাড়তেই দেখলাম রোনাল্ডো ছুটে এসেছে। ৩-২। শেষের বাঁশি বাজার পরেই উৎসব। পর্তুগাল খেলবে বিশ্বকাপ। সব হাসির মধ্যে একটা কান্না এ দাগ কেটে গেলো। এ যে খুশির কান্না।

       
                                          [ সেই মুহুর্ত ]


ইপ্সিত সময় এলো ২০১৩ তে বিগত চার বছরে জমানো কষ্টের বহিঃপ্রকাশ চোখের জলে ২০১৩ সালের ব্যালন ডি ওর বিজেতা রোনাল্ডো চোখের জল আর বাধ মানেনি বার বার এসে ফিরে যাওয়ার কষ্টগুলো বুঝি এক সাথে বেরিয়ে এসেছে। স্কোর দাঁড়ালো ৪-২। কেউ বললো আর পারবে না, এটাই শেষ। কেউ কেউ আশায় বুক বাঁধল, তুমি পারবে গুরু, পারতে তোমায় হবেই। একদল হাসলো ফিক ফিকিয়ে।

২০১৩-২০১8 সিজিনটা বেশ ভালোই কেটেছিল রিয়েল মাদ্রিদের। লিগটা হয়তো গেছিলো ফস্কে কিন্তু হাতে তখনো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ান্স লিগটা বাকি আছে। সামনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। লিসবনে খেলা শুরু বাঁশি বাজার কিছুক্ষনের মধ্যেই গোল দেগে দিলো অ্যাটলেটিকো প্লেয়ার। ব্যাস শুরু হয়ে গেলো গোল ধরে রাখার বিরক্তিকর খেলা। দাগা দাগা শট সব আটকে যাচ্ছে অ্যাটলেটিকোর মানব প্রাচীরে। কিছু কিছু ফাঁক ফোকর গলে বেরিয়ে গেলে আছেই তো গোলকিপার কুর্তোয়া। ইনজুরি টাইম, খেলার আয়ু যখন শেষ হবো হবো করছে তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সার্জিও র‍্যামোস। ৯২ মিনিট 8৮ সেকেণ্ড। সকল মাদ্রিদ ফ্যানেদের ক্যালান্ডারে এখনো দাগ করা আছে। শেষের বাঁশি বাজলো, ১-১। এক্সট্রা টাইম। এই পর্বে চললো ছেলেখেলার পালা। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে গেলো মানব প্রাচীর, গোলের পর গোল। অ্যাটলেটিকোর কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনল্ডো, যে হারার আগে কখনো হারে না। ২০১৪ তে রিয়েল মাদ্রিদ কে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ান করার সাথে সাথে নাম লেখালো রেকর্ডের খাতায়। এক টুর্নামেন্টে সব থেকে বেশি গোলের। পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে সেরার আসনে তখন রোনাল্ডো। বিশ্বকাপটা ভালো যায় নি। কিন্তু সারা বছর ধরে ক্লাব লেভেলে ভালো পরিশ্রমের পুরস্কার পেলো সে। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকা লিওনেল মেসির আর একটু কাছে এগিয়ে এল রনি। স্কোর এখন ৪-৩। কেউ কেউ মনে মনে ভয় পেলো, সেটা ঢাকতেই বাছা বাছা কথা ভেসে এলো, “এসব তো পাইয়ে দেওয়া,”; “টাকা দিয়ে কেনা”, “আজে বাজে ট্রফির কোনও মূল্যই নেই” আরো কত কি। একদল হাত জুড়ে প্রার্থনা করলো “ আরো, আরো।”

          ২০১৫, খুব একটা ভালো যায়নি। তেমন বিশেষ ট্রফিও নেই, নেই চ্যাম্পিয়ান্স লিগও। সেমিফাইনাল থেকেই জুভেন্তাসের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে। ফাইনালে জুভেন্তাস বনাম বার্সেলোনা। বলাই বাহুল্য বার্সেলোনা জিতেছে আর তার ফল স্বরুপ সেরার তাজিয়া মেসির হাতেই। স্কোর হয়েছে ৫-৩। হা হা হা, গাদা খানেক তাচ্ছিল্যের হাসি, নিছক অহংকার। অন্যদলের মনে প্রশ্ন, “আর কি সম্ভব???”
সম্ভব কিনা এই প্রশ্নের মাঝেই বুঝি ভগবান লিখে রেখেছিলেন বেস্ট স্ক্রিপ্টটা।২০১৬ বোধহয় রোনাল্ডোর জীবনে সব থেকে বড় মাইলফলক। ২০১৫ এর হারের পর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই গলা গেলো রিয়েল কোচের(যে রকম আগে হয়ে এসেছে) বড় দল ম্যানেজ করার দায়িত্ব পড়লো রাফা বেনিতেজের কাঁধে। শুরু থেকেই মনে হচ্ছিলো হড়কাবে, আর সেটাই হলো। মাঝপথেই দায়িত্ব নিতে হলো প্রাক্তন গ্যালাক্টিকোকে, জিনেদিন জিদান। রাতারাতি খোলনালচে বদলে দিলো গুমোট থাকা ড্রেসিংরুমটা। প্রমান পাওয়া গেলো মাঠের ভেতর, বহুদিন পর আসতে আসতেও স্প্যানিশ লিগটা ক্যাবিনেটে এলো না,তবে আশা দেখালো আচ্ছে দিনের। রাফা বেনিতেজের একটা ছেলেমানুষি ভুলের জন্যে কোপা ডেল রে-টা অনেক আগেই হাত ফস্কে গেছে। সামনে খালি চ্যাম্পিয়ান্স লিগ ফাইনাল। মুখোমুখি আবার রিয়েল মাদ্রিদ আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ২০১৪-এর ফ্ল্যাশব্যাকও বলা চলে।আঘাত, পালটা আঘাত সামলে নির্ধারিত সময়ে খেলার ফল -। মীমাংসা হলো না অতিরিক্ত সময়েও। অগত্যা ভরসা ট্রাইব্রেকার। শেষ শট নিতে যাচ্ছে রোনল্ডো, অভ্যাস মতোই। নিমেষের মধ্যে গোলকিপার কে এড়িয়ে বল জড়িয়ে দিলো জালে। আবার হৃত গৌরব ফিরে এলো রিয়েল মাদ্রিদের হাতে, ২০১৬ চ্যাম্পিয়ান্স লিগ তাদের মুঠোয়। আর তারই কান্ডারি নিজেই রেকর্ড ভেঙেছে নিজের। এক টুর্নামেন্টে সর্বাধিক গোলের নজির এখন তার অধীনে।

          এরই কয়েকটা দিন পরে শুরু হলো ইউরো কাপ। এর আগে ২০১৪ আর ২০১৫ তে ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল আর কোপা আমেরিকার ফাইনালে হেরে মেসি অলরেডি একটু পিছনের দিকে। ২০১৬ তে কোপা আমেরিকার শতবর্ষ উপলক্ষে একটা স্পেশাল কাপের আয়োজন হয়েছে। সে যাই হোক, তো ইউরোটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো রোনাল্ডোর কাছে। গ্রুপে আইসল্যান্ড,অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি। আদতে খুব একটা চাপের গ্রুপ না হলেও চাপটা এলো আইসল্যান্ডের সাথে ১-১ ড্র, আর অস্ট্রিয়ার সাথে গোলশুন্য ড্র করার জন্যে। গ্রুপের প্রথম দুই হওয়া একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠলো। তাই পরের রাউন্ডে যেতে তৃতীয় হতে হবে, কারন ৬টা গ্রুপের মধ্যে বেস্ট ৪টে তৃতীয় স্থান পরের রাউন্ডে যাবে। গ্রুপের শেষ ম্যাচ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। খেলা শুরুর কিছুক্ষনের মধ্যেই এলো প্রথম গোল, তবে হাঙ্গেরির তরফে। খেলায় তাপ উত্তাপ আবার ফিরে এলো নানির গোলে। মধ্যান্তরের কিছুক্ষন আগে নানির গোলে ফিরলো সমতা। স্কোর ১-১। মধ্যান্তরের পর এ যেনো অন্য খেলা। খেলা নতুন করে জমার আগেই ২-১ করে দিলো হাঙ্গেরি। খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ঝাঁপাল পর্তুগাল। ঘন ঘন আক্রমনের মাঝে কেমন যেনো ঘুম উড়ে গেলো হাঙ্গেরি ডিফেন্সের। এরই মধ্যে সকলকে থমকে দিয়ে অনবদ্য গোল করে গেলো রোনাল্ডো। গ্যালারি ফুঁসে উঠলো আবার, মন বললো এখনো সম্ভব।স্কোর ২-২।
         
 
                                             [সেই গোলের মুহূর্ত]


অগ্রগমন আবার কায়েম করে নিলো হাঙ্গেরি, ৩-২। কিন্তু আবার সেই রোনাল্ডো, তিনিই ত্রাতা, তিনিই বিধাতা। কর্নার থেকে আসা বলকে বাজপাখি সুলভ ক্ষিপ্রতায় চকিতে জালে জড়িয়ে দিলো হেড করে। নিস্তব্ধ গ্যালারি আবার গর্জে উঠলো, স্কোর ৩-৩। তার পর আর গোল হয়নি। কিন্তু তিন গোল আর কোনো ম্যাচ না হারার সুবাদে পয়েন্ট আর গোল পার্থক্যে পরের রাউন্ডে গেল পর্তুগাল। সামনে ক্রোয়েশিয়া। ক্লাব-ওয়ালা বন্ধু আজ হলো বিরোধী। রিকার্ডো কুরেশমার অতিরিক্ত সময়ের গোলে শেষ হাসি ফুটলো রোনাল্ডোর মুখে। কোয়ার্টারের দরজা খুললো, সামনে এবার রবার্ট লেওয়ান্দস্কির পোল্যান্ড। সে খেলারও গতি হলো সেই ট্রাইব্রেকারেই। টাইব্রেকারে রুই প্যাট্রিসিওর অনবদ্য দস্তানা ৫-৩ গোলে জয় এনে দিলো পর্তুগালকে। মন বললো দিল্লি বেশি দূর নয়। সেমিফাইনাল তো হয়েই গেছে। সেমিফাইনালে সামনে গ্যারেথ বেলের ওয়েলস। আরেক ক্লাব-ওয়ালা বন্ধুর সামনে এবার দাঁড়িয়ে রোনাল্ডো। সেমি ফাইনালে একদম বদলে গেলো দলের চেহারা। সেই বছর পঁচিশের রোনাল্ডোর ছবি যেন তুলে আনতে লাগলো বছর একত্রিশের রোনাল্ডো।
সেই ক্ষিপ্রতা, সেই গতি, সেই উদ্দামতা। সব মিলিয়ে টগবগ করে ফুটছে পর্তুগাল। যেমন ভাবা, তেমন কাজ, ড্রেসিংরুমের সেই উদ্দামতার প্রভাব যেন মাঠেও দেখা গেলো। ২-০ গোলে কার্যত উড়িয়ে দিলো ওয়েলসকে। গোলের মধ্যে সামিল রোনাল্ডোর একটা অসামান্য হেডার। দুই ডিফেন্ডার আর গোলকিপার কে তাক লাগিয়ে যেনো গোলার মতো জালে ধরা দিলো। খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই শুরু হয়ে গেলো নতুন জল্পনা, তাহলে কি কাপ হাতে এবার তাকে দেখা যাবে? সময় বুঝি উত্তর দেবে।

           টুর্নামেন্ট শুরুর সময় কেউ হয়তো কস্মিন কালেও ভাবেনি যে পর্তুগাল ফাইনালে আসবে।কিন্তু সব হিসাব নিকাশ বদলে দিয়ে ফাইনালে এসে দাঁড়িয়েছে পর্তুগাল। সামনে ফ্রান্স। সেই বিধ্বংসী ফ্রান্স, যে কিনা জার্মানির মতো দেশকে মাটি ধরিয়ে ফাইনালে এসেছে। একদম হাসলো খুব, বললো “এবার দেখবো কতো বড় প্লেয়ার, পুরো দুমড়ে মুচড়ে দেবে”, অন্য দল তখন ভাবে,”জ্বলে ওঠো ক্যাপ্টেন, এটাই তো সময়।”

          এটা বলা খুবই সোজা যে পোগবা, হুগো লরিস, উমতিতি, সিসোকো, জিরু, গ্রিজম্যান, পায়েত সমৃদ্ধ ফ্রান্সের কাছে পর্তুগালের শুধুই রোনাল্ডো। এই নিয়েই আশায় বুক বেঁধেছে হাজার হাজার মানুষ। খেলা শুরুর আট মিনিটের মাথায় বল দখলে আনতে দিমিত্রি পায়েতের একটা বাজে ট্যাকেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো রোনাল্ডো। দুনিয়া জুড়ে লোকের বুক তখন ঢিপঢিপ করছে। একদল হাসছে, একদল ভয়ে ভয়ে কাটাচ্ছে। না, হেরে যাওয়ার পাত্র সে না, আবার উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু না, পারছে না। হাঁটুর ব্যথায় বার বার দাঁড়িয়ে পড়ছে। বুঝলো তার জন্যে টিমের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ আর পারলনা। ম্যাচের বয়স তখন ২৩ মিনিট। চোখের জলে মাঠ ছাড়তে হলো রোনাল্ডোকে।

               

                                       [চোখের জলে মাঠ ছাড়ছে রোনাল্ডো]
দাঁত, নখ বের করে একে একে সব নিন্দুকেরা হাজির। কেউ কেউ হাসছে, কেউ কেউ পরিসংখ্যান বের করতে ব্যস্ত, কারোর সাজেশান শম্ভু মিত্রের পাশে বুঝি এখনই বসিয়ে দেওয়া ভালো রোনাল্ডোকে। এই মানুষটাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা মানুষ গুলোর যে কি হবে সেই কথা কারো খেয়াল নেই। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট সেদিন তখনই অনেক টিভি বন্ধ হয়ে গেছিলো। রেজাল্টতো সকলেরই জানা, ফ্রান্স এক প্রকার দুমড়ে দেবে পর্তুগালকে। কিন্তু ভগবানের লেখায় কিছু আলাদাই টুইস্ট ছিলো। একের পর এক ফরাসি গোলা আছড়ে পড়ছিলো পর্তুগালের রক্ষনে। কিন্তু দৃঢ় প্রতীজ্ঞ ডিফেন্ডাররা সেটা হতে দেয়নি। ডিফেন্স পেরিয়ে গেলেও ভরসা দিয়েছে রুই প্যাট্রিসিওর নির্ভরযোগ্য দস্তানা। দুএকবার গোলপোস্টগুলোও পর্তুগালের জার্সি পরেছে। নির্ধারিত সময় পেরোলো গোলশূন্য ভাবেই। মাঠের পাশে তখন দাঁড়িয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে কোচকে সরিয়ে নিজেই তখন ব্যাটন তুলে নিয়েছে।

এখন নয় তখন, স্বপ্ন ভাঙবেই, এই মানসিক প্রস্তুতিতেই সময় কাটছিলো বহু মানুষের। ঘোর কাটলো ১০৯ মিনিটে, কিছুটা অচকিতেই। বক্সের বাইরে থেকে হঠাত করেই একটা শট মাটি ঘেঁসে ঢুকে গেলো হুগো লরিসের চোখে ধুলো দিয়ে। ক্ষনিকের জন্যে বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেলো সময়, সব আওয়াজ, সকল হৃদস্পন্দন। গোওওওওওওওওওলোলললললল……… কিছু জানা বোঝার আগেই স্কোরবোর্ড দেখালো পর্তুগাল ১ ফ্রান্স ০। উৎসব হলো, কিন্তু না; কাজ এখনো বাকি। আবারো একে একে গোলা আস্তে থাকলো, কিন্তু সব চেষ্টাই গেলো বিফল। শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথেই আর বাঁধ মানলো না। আগল ভেঙ্গে মেতে উঠলো উতসবে। পর্তুগাল জিতলো ইউরো কাপ। লাখো লাখো দর্শকের চোখের জলের আজ ধুয়ে গেলো বহু বছরের অভিশাপ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর হাতে উঠলো ইউরো কাপ। সব সত্যি কে মিথ্যে করে, সব জল্পনাকে স্তব্ধ করে, অসম্ভবকে সম্ভব করে আবার ফিরে এলো ক্রিশ্চিয়ানো রোনল্ডো। একদল বুক ফুলিয়ে বললো, “ হ্যাঁ, এখনো সম্ভব। তুমিই পারো গুরু, তুমিই।” ; অন্যদল মুখ ঘুরিয়ে বললো “ হা হা হা, ফাইনালেই তো খেললো না…” । ভয় পেলে অবশ্য এরমই করে মানুষ।

ফাইনালের কিছু মুহুর্তঃ-

                                 
                                                                [যন্ত্রনায় কাতর রোনাল্ডো]


                                                      [চোখের জলে বিদায়]


                                      [পায়ে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে কোচের ভূমিকায়]


                                                       [এদেরের সেই শট]

[কোচের সাথে উচ্ছাসে রোনাল্ডো(গোলের পর)]

[শেষ বাঁশি বাজার কিছুক্ষন আগে]



                                                       [গোলের পর রোনাল্ডোকে আলিঙ্গন]

                    [জয়ের পর বাঁধনহারা কান্না]                       
                                                                                                                                                          
                                                       
                                                               [ট্রফি হাতে তোলার মুহুর্তে]

                                                                
                                                               [একান্তে ইউরোর সাথে]


স্বভাবতই ইউরো জেতার পর এটা আর বলার অবকাশ রাখে না যে ব্যালন ডি ওর কার কাছে গেল। প্রায় এক প্রকার অপ্রতিরোধ্য ভাবেই সবার প্রত্যাশাকে সফল করে ব্যালন ডি ওর গেলো রোনাল্ডোর কাছেই। এই বার তবে কোনো উচ্চ-বাচ্চ্য শোনা যায় নি। একদল তখন গলা ফাটিয়ে বললো, “ তুমি অসাধারন, তুমিই পারো। বারে বারে তুমি সবাই কে ভুল প্রমান করেছো এল মায়েস্ত্রো।” অন্য দল আজ শান্ত, প্রমাদ গুনছে পরের বারের জন্যে। স্কোরবোর্ড এখন জ্বলজ্বল করছে, লেখা আছে ৫-৪।

২০১৭-এর শুরুটা ভালো হয়নি একদমই। চোট আঘাতের দরুন বহুদিন পর মাঠে ফেরত আসে রোনাল্ডো। তবে রোনাল্ডোর উপস্থিতিতেই ঘরে উঠলো সুপার কাপ। সেভিয়া কে ৩-২ গোলে হারিয়ে ইউরোপিয়ান সুপার কাপের মালিক হলো রিয়েল মাদ্রিদ। সে যাই হোক, লা লিগা তে শুরুতে হোঁচট খেলেও পরের দিকে বেশ সামলে নিয়েই তর তরিয়ে চললো। সব দিকেই তরতরিয়ে ছুটছে কিন্তু এরই মাঝে চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ালো রোনাল্ডোর গোল না পাওয়া। যে চ্যাম্পিয়ান্স লিগ রোনাল্ডোর গোলের ভাঁড়ার ঘর, সেই ঘরেই নাকি আজ খাবার নেই। গ্রুপ লিগে ৬ ম্যাচের পর ২ গোল। বিদ্রুপ তো লেগেই থাকে, সেটা বিশেষ চিন্তার ব্যাপার না, চিন্তা হলো ঘরের মাঠে শোনা বিদ্রুপ গুলো। আগেও বলেছি, আবারও বলছি দর্শক হিসাবে স্যান্টিয়াগো বার্নাবিউ-এর সুনাম কোনো দিনই ছিলো না। ঘরের মাঠে বিদ্রুপ ধ্বনি বেজে উঠলো বার বার। অনেকেই হাসলো, অনেকে চোখ কুঁচকে চিন্তারত, “তাহলে কি এটাই শেষের শুরু?” প্রশ্নটা অনেকের মনেই বার বার ইকো হতে থাকলো। মন চাইছিলো আবার একটা ম্যাজিক হোক, কিন্তু মাথা সায় দিলো। মাথা প্রবোধ মানালো, এটাই বুঝি শেষের শুরু। কিন্তু সে তো রোনাল্ডো, শেষ হওয়ার আগে কখনো শেষ হয় না। বাড়তে থাকা প্রশ্ন গুলোকে এক মুহূর্তে থামিয়ে দিয়ে, নিন্দুকদের গালে সপাটে চড় মেরে আবার ফিরে এলো পুরোনো ছন্দে। রাউণ্ড অফ সিক্সটিন, সামনে নাপোলি। এক প্রকার তুড়ি মেরে ৬-২ গোল পার্থক্যে পরের রাউণ্ডে চলে গেলো রিয়েল। রোনাল্ডোর গোল নেই। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল, সামনে রনসজ্জিত বায়ার্ন মিউনিখ, যার সামনে বড় বড়দের প্রান ওস্ঠাগত হয়ে যায়। এদিকে আবার অফ ফর্মের রোনাল্ডো। একে বায়ার্ন, তার ওপর রোনাল্ডো গোলের মধ্যে নেই, দুনিয়ার তাবড় তাবড় কোচের গালেও হাত পড়ে যাবে। কিন্তু সেরারা হয়তো এরকমই হয়, ঠিক সময়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে চারদিক ঝলসে দেয়। সেদিনও তাই হলো। আলিয়ান্স এরিনায় সেদিন বায়ার্নের গোলা বর্ষন চলছে, কোনক্রমে সামাল দিতে দিতেই এক গোল খেয়ে বসলো রিয়েল, ফলাফল ০-১।প্রথমার্ধের একদম শেষের দিকে ক্যাসিমিরোর ভুলে পেনাল্টি আদায় করে নিলো বায়ার্ন। ভাগ্য সুপ্রশন্ন যে ভিদালের নেওয়া সেই শট ওই তিন কাঠির মধ্যে থাকেনি। হাফ টাইম, স্কোর ০-১। কিন্তু সেকেন্ড হাফে এলো এক অন্য চমক। মুককিটে থেকে শুঁয়োপোকা যেভাবে খোলস কেটে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি হয়ে, এখানেও ঠিক সেরকমই হলো। আলিয়ান্স এরিনায় তখন পাখার রঙ ছড়াচ্ছে রিয়েল। দর্শকেরা সিটে ঠিক করে বসার আগেই গোওওওওওওওললললল.................. গোলদাতা রোনাল্ডো। মরুভুমিতে বৃষ্টির মতো বাঁধ ভেঙ্গে এলো উচ্ছাস। কোচের স্বস্তি। স্কোর ১-১। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন সারা মাঠ ধরে রিয়েল মাদ্রিদ এঁকে চলেছে হরেক রকম ছবি, আর তারই মাঝে হারিয়ে গেলো বায়ার্ন। আবার একটা গোল, ২-১ করে জার্মান জয় করে ফিরলো রিয়েল, ওরফে রোনাল্ডো।

          ফিরতি লিগটা কিন্তু প্রচণ্ডই চাপে রেখেছিলো রিয়েলকে। ঘরের মাঠে খেলা, রোনাল্ডোর ফর্মে ফেরা সব কিছু অনুকূল গেলেও বিপক্ষে কিন্তু জার্মান। যে কোনো দিন যা খুশি করে দিতে পারে। খেলার প্রথমার্ধ গোলশূন্য ভাবে শেষ হলেও পরের অর্ধে শুরুর দিকেই গোল দেগে দিলেন বায়ার্নেই রবার্ট লেওয়ান্দস্কি। ফলাফল ০-১(মোট ২-২)। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বায়ার্নের চাপের কাছে প্রায় মাথা নুয়েই যাচ্চিলো রিয়েলের, কিন্তু তখনই ত্রাতার ভূমিকায় সেই রোনাল্ডো। বিশ্বসেরা গোলকিপার ম্যানুয়েল নুয়ারের পায়ের তলা দিয়ে নাটমেগ করে বল জালে জড়িয়ে দিলো রোনাল্ডো। স্কোর ১-১(মোট ৩-২)। কিন্তু এই রেজাল্ট বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। র‍্যামোসের একটা বাজে ভুলের খেসারত দিতে হলো রিয়েল কে। নিজের জালেই বল জড়িয়ে দিলেন র‍্যামোস, স্কোর ১-২( মোট ৩-৩)। শেষ বাঁশি বাজলো কিনতু দুই লিগে সমান গোল আর সমান সংখ্যক অ্যায়ো গোল থাকার দরুন ম্যাচ গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু আবার সেই, অন্য খেলা। খোলসে থাকা রিয়েল মাদ্রিদের পুনর্জন্ম হলো, রোনাল্ডোর হ্যাট্রিকের সাথে সাথে ৪-২ গোলে গুঁড়িয়ে গেলো, দুই পর্ব মিলিয়ে ৬-৩। কোয়ার্টার ফাইনালের দফা রফা। এবার সেমিফাইনাল।


সেমিফাইনালটা আগের বারের ফাইনালের রিটেক। সামনে সেই ফুটতে থাকা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। রোনাল্ডো গোলে ফিরেছে এর থেকে স্বস্তিদায়ক কথা আর কি বা হতে পারে একজন কোচের কাছে। তবুও চিন্তা তো একটা থেকেই যায়। মাদ্রিদ ডার্বির জ্বলজ্বলে আগুনে তখন ভিনসেন্টে ক্যালডেরন ফুটছে। সদলবলে হাজির সবাই খেলা দেখতে। কিন্তু ঘরের মাঠে এরম যে কাব্য লেখা হবে সে চিন্তা কস্মিনকালেও করেনি অ্যাটলেটিকো দর্শকেরা। খেলা শুরুর দশ মিনিটের মধ্যেই দুরন্ত হেডারে রিয়েলকে এগিয়ে দিল রোনাল্ডো। তার পরে বাকি সময় জুড়ে শুধুই রিয়েল, রিয়েল আর রিয়েল। বিপক্ষের ডিফেন্সকে এক প্রকার ছিঁড়ে রেখে দিলো ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। একটা আঘাত সামলে একটু নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই উড়ে আসছে আরেকটা আঘাত। শেষমেষ কার্যত আত্মসমর্পন করেই দিলো অ্যাটলেটিকো। খেলার শেষে স্কোরবোর্ড হেসে বললো রোনাল্ডো ৩- অ্যাটলেটিকো ০। বহুদিন ধরে জমে জমে আসা প্রশ্ন গুলো যেনো উত্তর পেলো, জন্ম হলো নতুন রোনাল্ডের। গ্রুপ লিগে দু গোল করা প্লেয়ারের ঝুলিতে জমা দিলো দশ গোল, যার মধ্যে পাঁচটা নাকি বায়ার্নের বিরুদ্ধে।


     [হ্যাটট্রিকের পর হয়তো নিন্দুকদের দিকে চেয়েই হাসছে রোনাল্ডো]

ফিরতি লিগে ২-১ গোলে হারলেও মোট গোলের সুবাদে ফাইনালে চলে যায় রিয়েল মাদ্রিদ। এই খেলায় মাদ্রিদের হয়ে গোল করে ইস্কো। তার মানে আবার একটা ফাইনাল, এবার সামনে যুভেন্তাস; বকলমে বুঁফো বনাম রোনাল্ডো। রিয়েলের মাঝমাঠ বনাম ইতালিয়ান ডিফেন্স।

          বহুদিন ধরেই কথা চলছে নাকি রোনাল্ডোর বুঁফোর বিরুদ্ধে রেকর্ড ভালো না। এসব অবশ্য চিত্তগুপ্তের খাতা ঘাঁটা হিসাব। তবুও সেটা কে সত্যি ধরে নিলে হাতের সামনে এর থেকে ভালো সুযোগ আর আসবে না। ইতি মধ্যে বলে রাখা ভালো স্প্যানিশ লিগ ইতিমধ্যেই ক্যাবিনেটে জ্বলজ্বল করছে। এটাই আপাতত ২০১৬-২০১৭ মরসুমের শেষ ম্যাচ। কার্ডিফে ২০১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ান্স লিগ যেনো দুটো ভাগে ভাগ করে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে। একদম মন প্রান দিয়ে চাইছে যাতে বুঁফোর হাতে ট্রফিটা ওঠে, আর অন্য দলের আর্তি আরো একবার। খেলা শুরু হলো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। ম্যাচ গড়াতে না গড়াতেই আস্তে আস্তে হয়ে উঠতে লাগলো রিয়েল-ময়। ২০ মিনিটের মাথায় মাথায় একটা মাপা কোনাকুনি মাটি ঘেঁষা শটে গোলের জাল কেঁপে উঠলো। গোওওওওওললললললল...... বুঁফোকে পরাস্ত করে বল চলে গেল গোলে। গোলের মালিক সেই রোনাল্ডো। যদিও এই অগ্রগমন ধরে রাখতে পারলো না রিয়েল। মিনিট খানেক পরেই একটা অনবদ্য ব্যাকভলিতে সব হিসাব পালটে দিয়ে সমতায় এলো বুঁফোর দল। প্রথমার্ধো এভাবেই শেষ হলো। প্রতিবারের মতো দ্বিতীয় অর্ধ যেনো আবারও অন্য রিয়েল মাদ্রিদকে তুলে ধরলো। খেলা শুরুর মিনিট পনেরো পর ক্যাসিমিরোর একটা যুভেন্তাস ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে দিক বদলে নিলো, বুঁফোর চোখে ধুলো দিয়ে পৌঁছে গেলো গোলের ঠিকানায়। স্কোর ২-১। এর পর যেনো চোখে পলক পড়তেই একটা করে গোলে হতে লাগলো। ৭১ মিনিটের মাথায় লুকা মড্রিচের একটা আসামান্য পাস প্রায় পাঁচ ডিগ্রি কোনের কাছাকাছি অবস্থা থেকে জালে জড়িয়ে দিলো রোনাল্ডো। স্কোর ৩-১। রোনাল্ডোর ঝুলিতে ১২ গোল। যুভেন্তাসের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দেয় মার্কো আসেনসিও।
খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই আনন্দে ফেটে পড়লো সব রিয়েল সমর্থক। এতো আনন্দের মাঝে বুঁফোর চোখের জলটা সবার চোখ এড়িয়ে গেলো। সেদিন অন্য দল বলে ফেললো, “টু মেনি ইম্পর্ট্যান্ট গোল ইন টু মাচ ইম্পর্ট্যান্ট স্টেজ। ” অন্য দল তখন আনন্দ অবগাহনে মত্ত।

                                  [চ্যাম্পিয়ান্স লিগ ২০১৭ এর ট্রফি হাতে রোনাল্ডো]

          ২০১৭ মরসুম এখন চলছে, ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ঘরে এসে গেছে ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ আর ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ। স্প্যানিশ লিগে আশানুরূপ পারফর্ম করতে না পারলেও বাকি সব জায়গায় একদম দৌড়াচ্ছে রোনাল্ডোর গাড়ি। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ান্স লিগে ইতিমধ্যেই আট গোল করে ফেলেছে, আর বাকি টুর্নামেন্টেও বেশ কয়েক গোল করেছে। এতো কিছুর মধ্যে আবার আসর বসেছিলো ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার আর ব্যালন ডি ওর-এর। প্রশ্নতীত ভাবেই সেরার কাছেই সেরার মুকুট পৌঁছে গেছে। একদল এখন একদম চুপ, মাঝে মঝেই আসছে আওয়াজ “এসব বেকার ট্রফি নিয়ে কি আর হবে, সবই তো পয়সা দিয়ে কেনা।” অন্যদল এখন শান্তির নিঃশ্বাসের মাঝে আওড়াচ্ছে, “ তুমি বলেই সম্ভব, তুমিই পারো; শুধু তুমিই।” স্কোরবোর্ডটা বেশ ঝাপসা দেখাচ্ছিলো, সামনে আসতে দেখলাম লেখা আছে ৫-৫। পরিহাস না করেই আবার হাঁটতে শুরু করলাম, কখন বুঝি স্কোরবোর্ড আমাদের দিকে এক কদম এগিয়ে যায়। :D


                                          [পঞ্চম ব্যালন ডি ওর হাতে]


এতোটা লেখা পড়ার পর একটা প্রশ্ন স্বভাবতই মাথায় আসার কথা, সেই অ্যালবার্টের কি হলো? তার কোনও চিহ্ন তো আর পাওয়া গেলো না। অ্যালবার্ট আর ফুটবল খেলেনি, মানে সেরম কোনো উল্ল্যেখ পাওয়া যায় না। সবার চোখের আড়ালে অ্যালবার্ট রয়ে গেছে সেই ফাইনাল পাস দেওয়া বন্ধু যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিলো একটা নতুন স্বপ্ন। প্রশ্ন করা হয়েছিলো তাকে, আপনার সংসার চলে কি করে, কি করে দাঁড় করিয়েছেন এই বিশাল বাড়ি। উত্তর একটাই এসেছিলো, “ইটস অল বিকজ অফ রোনাল্ডো।” হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে এভাবেই একটা বন্ধুর কাছে আমরন দেনা শোধ করে যাবে রোনাল্ডো। রোনাল্ডো কে? শুধুই কি একটা গোলের মাপকাঠি? শুধুই কি শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন? শুধুই কি ইর্ষার কারন? না, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এর থেকে অনেক অনেকটা বেশি কিছু। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সেই হারতে থাকা মানুষের প্রতীক যাকে রোগা হওয়ার জন্যে বিদ্রুপ শুনে পালটা জবাব দিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সেই মানুষ যে নিজের হার্টকে শান্ত করে মৃত্যুর মুখ থেকে ড্রিবল করে বেরিয়ে আসে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সে যে প্রতিটি দিন নিজেকে প্রস্তুত করে একটা নতুন লড়াইয়ের জন্যে। সারা দুনিয়া যখন মুখিয়ে থাকে একটা ভুল ধরে সেটা নিয়ে হালাল করে খাবার জন্যে সেই জায়গা থেকে সবাইকে থমকে দিয়ে নতুন করে এগিয়ে চলার নামই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সে যার গোল করার জন্যে সমালোচনা হয়, সমালোচনা হয় গোল না করার জন্যেও। যার প্রতি গোলে কেউ পা মুক্তির আশ্বাস, কেউ পায় বারুদের গন্ধ, যার প্রতিটা দিন আসলে একটা কঠিন অধ্যাবসায়ের ব্যালেন্স-সিট। সাধারন হয়ে একজন অসাধারনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসার নামই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সে যে অবলীলায় নিজের সোনার জুতো নিলামে তুলে দেয় অনেক শিশুর অপারেশানের জন্যে, যে অবলীলায় বাঁচায় লাখ লাখ রোগীর জীবন, অবলীলায় নিজের পুরস্কার বিক্রি করে বন্যা নিপীড়িতদের জন্যে করে দেয় আশ্রয়। প্রতিটা সাধারন মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো শুধু একটা মানুষ না, একজন অনুপ্রেরনা, যেটা বার বার চোখে আঙ্গুলদিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। কেউ যেনো বলছিলো “ যদি তুমি কোন মানুষের ঘৃনা না পাও, তাহলে তুমি কখনো সফল নও।” আজ যেনো সেই কথাটাই বার বার মনে করিয়ে দেয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কথা। এতো অপমান, বিদ্রুপ, ইর্ষা সহ্য করার পরেও উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা যে রাখে, ক্ষমতা রাখে সবাই কে চুপ করিয়ে নতুন কোনো স্বপ্নের জন্ম দেওয়ার, সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। সবাই হয়তো ভালোবাসায় বাঁচে না, কখনো কখনো ঘৃনাও মানুষ কে অমর করে দেয়।


          হাজার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা মানুষ গুলোর কাছে তুমিই অনুপ্রেরনা, তুমিই ভরসা, তুমিই অস্তিত্ব।
এই জমিয়ে রাখা বিদ্রুপ গুলোই একদিন হবে তোমার প্রতিরোধ, সমস্ত দুনিয়া মাথা নত করে মেনে নেবে তুমিই আসল ‘ম্যান অফ স্টিল’। সেদিন নাহয় আরো একবার আড্ডায় বসা যাবে... J





--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...