Monday, 19 December 2016

বিসর্জন

              পুজো আসছে পুজো আসছে করে করে এই এক মাস বেশ ভালই কাটছিলো। দেখতে দেখতে দশমীটাও চলে এলো। মানে ঠিক মতো বোঝার আগেই পুজো শেষ। আবার প্রতীক্ষার একটা বছর। মানে জাস্ট ভালো লাগে না। পুজোর সামারি কি এটা জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো বুঝতে পারাটা খুব মুশকিল। ষষ্ঠী অবধি অফিস, তারপর সপ্তমী থেকে বৃষ্টি। মানে কাদা প্যাচ প্যাচ আর হাঁফ ওঠা গরম। তার ওপর সারে সারে মানুষের ভিড়। মানে এই সব কিছুর চক্করে পড়ে ঠাকুর দেখাই হলো না। গাঁটে গুনে একটা, তার পরেই ক্ষেমা দিয়েছি আমি। খাবার জায়গায় গিয়েও স্বস্তি নেই। সব জায়গায় এক হাল। যাই হোক, পুজো শেষ, তাই দুঃখ প্রকাশ করাটা একটা নৈতিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে সব বাঙ্গালির। আমিও সেই দলেই নাম লিখিয়েছি, নাহলে আমার আভিজাত্য নিয়ে আবার টানাটানি পড়ে যাবে। মুখে যাই বলি না কেন মনে মনে এই জ্যাম, ভিড় ভাট্টা থেকে আমি নিস্কৃতি চাইছি। ব্যাস। পুজোটা এই বৃষ্টিটাই কেমন যেন মাটি করে দিলো।
              একটা বছর কোথাও বেরতে না পেরেই এই অবস্থা। তাজ্জব লাগে পাড়ার মৃনাল জেঠ্যু কে দেখে। বছরের পর বছর সেই এক রুটিন। পুজো বলতে নতুন কিছুই নেই। শুধু একটু বাড়ির আলো গুলো জ্বেলে রাখা, ব্যাস এটুকু। বেশ কয়েক বছর ধরেই মৃনাল জ্যেঠুর স্ত্রী কণিকা জ্যেঠিমা অসুস্থ,শয্যাশায়ী। ছেলেও চাকরির কারনে বাইরে থাকে, পুনেতে। তাই বাড়িতে একা একাই থাকা আরকি। জ্যেঠিমার তো ওই ঘরটায় খালি ,বাকি সারা বাড়িটাতেই ছায়া সঙ্গী হিসাবে কেউ আর নেই। ছেলে নেই,দেখা সাক্ষাৎ ওই তিন চার মাসে একবার। ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে, তবে কাঁধে এসে হাত রাখার মতো কেউ নেই। তাই একাকিত্ব কেমন যেন কাছে টেনে নেয়। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। কিন্তু জ্যেঠুকে দেখে বোঝার উপায় নেই বিন্দু মাত্র। লাস্ট ৬-৭ বছর রিটায়ার করেছেন, কিন্তু এখনও তার কোনও ছাপ পড়েনি। জ্যেঠু ডালহৌসি চত্বরের বেশ নাম করা একটা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্ছ ম্যানেজার ছিলেন। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকার কথা নয়। বেশ জাঁকিয়ে অফিস ও করেছে অনেক বছর ধরে। ছেলেটা অত ভালো ছিলো না পড়াশোনায় কিন্তু কালে কপালে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে। তবে এতো টাকা পয়সা থাকলেও গুমোর ছিলো না একদম। আমরা মাটির মানুষ বলতে যা বুঝি জ্যেঠূ একদম সেরকম। খুব সাদা মাটা,হাসি খুশি মানুষ জ্যেঠু। জ্যেঠিমার একটু গুমোর ছিলো বটে কিন্তু আমাদের কাছে তেমন প্রকাশ দেখিনি, লোক মুখে যেটুকু শোনা আর কি। সেরিব্রাল পালসি হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে সব কিছু। এক কালে জমজমাট বাড়িটায় এখন আর সেই প্রানচ্ছলতা নেই। পিন পড়ার আওয়াজটাও কেমন যেন রেকর্ড হয়। 
জ্যেঠিমার টুকটাক শরীর খারাপ লেগেই থাকতো। মানে ওই আর কি যা হয়, জ্বর জ্বালা আর সেই বাঙালি ফেমাস “অম্বল”। কিন্তু এটা কেমন যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো। জ্যেঠুর কেমন লেগেছিলো সেটা বোঝার বা বলার মতো ভাষা আমার নেই, তবে পুরো পাড়ার লোক কেমন যেন আকাশ থেকে পড়েছিলো। দু তিন বছর আগে সেরিব্রাল পালসির নাম লোকের কাছে অনেক টা হিব্রু ভাষার মত ছিলো। গাঁটে গোনা কয়েক জন,যারা খুব বই টই পরে, বা সিনেমা টিনেমা দেখে তারা ছাড়া এই নামটা তেমন কারো জানা ছিলো না। রোগটা প্রথম জানা যায় স্টিভেন হকিন্সের কাছ থেকে। স্টিভেন হকিন্স এই রোগের শিকার ছিলেন। প্রথম প্রথম আমিও বুঝতে পারিনি,পরে সিনেমা দেখে জানলাম আসল ব্যাপারটা কি, কেন এই রোগ হয়,কি উপসর্গ এই সব আর কি। রোগের কিনারা করতে পারলেন না কোনও ডাক্তার। দিন দিন আরো বিছানায় মিশে যেতে থাকলেন জ্যেঠিমা। সেই থেকেই সঙ্গিনী ২৪ ঘন্টার আয়া আর জ্যেঠু। মাথার পাশের ওই জানলাটা কেমন যেন স্বর্গের মতো হয়ে গেছে। ওটাই আকাশ, ওটাই বাতাস, ওটাই চিলেকোঠা,ওটাই মুক্তি। বেশ চলছে তো দু বছর ধরেই। 
পাড়ার পুজোটা মৃনাল জ্যেঠুর বাড়ির পাশেই হয়। মানে ওই যে জানলাটার কথা বললাম ওই জানলার থেকে একটু দুরেই। ঘাড় উঁচিয়ে দেখলে অনায়াসেই ঠাকুর দেখতে পাওয়া যাবে,মানে একদম ঝক ঝক করে, এমনই দুরত্ব । পাড়ার পুজোয় আলো বাঁধা থেকে মাইকে গান বাজানো সব কিছুর হিসাব কষে রাখে ওই ঘরটা। জ্যেঠু এক সময় পাড়ার পুজোর মাথা ছিলেন। এখন বয়স বেড়েছে, তার ওপর জ্যেঠিমার এরম অবস্থা, তাই সেই সব বোঝা এখন জ্যেঠু অন্যের কাছে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। তবে এখনও পুজো মন্ডপে আসেন, সম্ভব মতো সাহায্যও করেন, বাড়িতে বউ সামলে যতটুকু করা যায় আর কি। তবে কিছু হোক না হোক প্রতিবারে সন্ধিপুজো আর বিসর্জনের দিন জ্যেঠু কে মন্ডপে দেখা যাবেই। এবার তো আবার হাই কোর্টের আদেশ মতো সন্ধ্যে ৬টার আগে ঠাকুর জলে ফেলতে হবে,তাই বেলা বেলিই ঠাকুর ভাসান দেওয়ার পালা। এই ৩টে-সাড়ে ৩টে নাগাদ করে বরন শুরু হলো। নিয়ম মতো এবারেও হাজির জ্যেঠু। বরন মিটতে মিটতে ওই বেজে গেলো পৌনে পাঁচটা-পাঁচটা। সব সেরে ঠাকুর লরি তে তুলে দিয়ে জ্যেঠু বাড়ি ফিরে গেলেন। তার পর হাত মুখ ধুয়ে, ঠাকুরের পায়ে ঠেকানো ফুলটা নিয়ে জ্যেঠিমার মাথায় ঠেকিয়ে দিতে গেলেন,
– ওহ, তুমি ফিরে এসেছো?
– হুম, এই তো ঠাকুর লরি তে তুলে দিয়ে এলাম। দাঁড়াও মাথায় ফুলটা ঠেকিয়ে দি তোমার।
– ধুর, এসব করে আর হবে কি?
– কি হবে মানে? প্রতি বছরই তো আমি করি। এমন ভাবে বলছো যেন আগে কখনো দেখোনি।
– না না। সেটা বলিনি। বললাম এসব করে আর কি হবে? আমার তো হয়েই এলো… (শুকনো হাসি)
– এই এসব বাজে কথা বলা থামাও তো। দেখি হাতটা সরাও মাথা থেকে।
– (হাত সরিয়ে) আচ্ছা এবার ঠাকুরের জন্যে কত বড় লরি এসেছিলো?
– (মাথায়,বুকে ফুল ছুঁইয়ে দিতে দিতে) ওই যেমন আসে প্রতিবার, ওরমই এসেছিলো আর কি। আগে তো দেখেইছো।
– আচ্ছা। ঠাকুরটা ঠিক কতটা বড় হয়েছিলো?
– এবার একটু বড়ই ছিলো। মানে অন্যবার যেমন হয় তার তুলনায় একটু বড়ই ছিলো।
– ওহ। তার মানে এবার আর লরিতে ঠাকুর তোলার পর জায়গা পাওয়া যায় নি। ইশশ্…
– হ্যাঁ, ওই ছিলো আর কি। এতে তোমার ইশশ করার কি হলো?
– না এমনি। জায়গা থাকলে আমার খাটটাও তুলে দিতে পারতে তো। মায়ে ঝিয়ে এক সাথে বিসর্জন হয়ে যেতো। (দুঃখচাপা হাসি একটা বিকট আওয়াজ করে)
– কনি, আবার?? আবার তুমি এসব আবোল তাবোল কথা বলছো তো?
– আরে আরে তুমি চটছো কেন? একবার ভেবে দেখোতো কতো সুবিধা হতো তোমার। এই জ্বালা বয়ে বয়ে আর কতদিন চলবে বলো। আমারও তো তোমার কথা ভাবতে হবে নাকি। (দেঁতো হাসি)
– কনি তুমি খুব ভালো করে তো জানো এসব কথা আমার ভালো লাগে না। তাহলে কেন বলো এসব?
– আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে আমার। এবার খুশি? (হাসি)
– হ্যাঁ। (হাসি)
– দেখলে তো বাবুটা এবারও এলো না। কি যে এতো কাজ করে কে জানে।
– হ্যাঁ সেই তো। বলেছিলো চেষ্টা করবে। কিন্তু হয়তো কাজের চাপে আটকে গেছে তাই আসতে পারে নি।
– কাজের চাপ না ছাই। ওসব আমার জানা আছে। এমনি আসে নি গো,এমনি।
– এমনি? কি যে বলছো না…
– আরে হ্যাঁ গো। এমনি আসেনি। এই আধ মরা মায়ের মুখ দেখতে এসে কে পুজোটা মাটি করতে চায় বলো? (হাসি) বলতে পারতে তোর মা মরে গেছে, তাহলে হয়তো একবার সময় করে দেখতে আসতো। আমার ও দেখা হয়ে যেতো। (হা হা হা করে হাসি)
– কনি, এবার মনে হয় আমার কথা না বাড়ানোই ভালো। কথা বাড়লেই তুমি আবার এসব বলতে শুরু করবে, আর আমার সেগুলো ভালো লাগবে না। তুমি না আমার দিকটা একদম ভাবোই না।
– আরে না না চাটুজ্জ্যে মশাই। সময় থাকতে শুধরে যাও।
– শুধরে যাও…!! মানেটা কি?
– সবাই বেলাবেলি পথ দেখে নিয়েছে বা নিচ্ছে। তুমিও এবার পথ দেখে নাও। বাবুও দেখে নিলো। তুমি আর কতোদিন মায়া আঁকড়ে পড়ে থাকবে।
– তুমি কি আমার কোনও কথা শুনবে না? এসব কথা বলেই যাবে??

রাগে যখন জ্যেঠু মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছে, জ্যেঠিমা তখন আস্তে আস্তে হাতটা রাখলো জ্যেঠুর হাতের ওপর। কতো ইমসান, কতো কথা কেমন যেন মুহুর্তের মধ্যে বদলে গেলো এই হাত থেকে ওই হাত। কেউ বুঝলো না, শুধু ওরা।

– কেন এতো ভালোবাসো?
– জানি না। কলেজে পড়ার সময় ও বার বার জিজ্ঞাসা করতে, তখনো তো উত্তর দিতে পারিনি। আজ কি করে দেবো তাহলে?
– হুম। (নিশ্চুপ)
– কেন বলো ওসব কথা?
– জানি না। তোমায় ছেড়ে যেতে যে মন চায় না। কিন্তু… (মুখ ফিরিয়ে, চোখের কোণটা চকচক করছে)
– কে যেতে বলছে? আর কোনও কিন্তু না। কোথাও যেতে হবে না তোমায়।
– আচ্ছা এবার ঠাকুরে কাছে কি চাইলে?
– সে বলতে আছে নাকি কাউকে?
– অমনি? আমায় তো বলতেই পারো, আমি না তোমার বেটার হাফ? (হাসি)
– তাহলে তোমার তো জানাই উচিত আমি কি চাইতে পারি…!!
– কি? (বিস্ময়ে)
– সেটাই যেটা প্রতিবারে চাই।
– (হাসি)
কথায় কথায় খেয়াল নেই যে কখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মন্ডপের আলোর সাথে জ্যেঠিমার হাসি তে কেমন যেন ঘরটা আলোয় ভরে গেছে। মন্ডপ থেকে কখন যে এসে দধিকর্মা দিয়ে গেছে জানতেই পারেনি ওরা কেউ। ওরা হাসছে। প্রান খুলে আবার হাসছে ভবিষ্যতের চিন্তা কে দূরে রেখে একটু কিছুক্ষনের জন্যে প্রান খুলে হাসছে। 
মায়ের বিসর্জন যে হয় না কখনো।
একটু দধিকর্মা রেখে দিলাম আপনা দের জন্যেও, সময় মতো খেয়ে নেবেন। শুভ বিজয়ার প্রীতি শুভেচ্ছে আর আন্তরিক অভিনন্দন। সারাবছর ভালো কাটুক, রসেবশে হাসি খুশি তে আনন্দে কাটুক আপনাদের প্রিয়জনের সাথে।
মিস্টিমুখ… (হাসি) 

নশ্বর

আমি জানি নশ্বর আমি; একটা একটা দিন ফুরায় আর আমি গুনি; এই বুঝি বাজল সাইরেন; শরীরের কারখানায় যখন ধীরে ধীরে কর্মবিরতি আসতে থাকে হঠাৎ করেই একদিন ...